ধামাচাপা দেয়ার নীতি এবং মানুষের ঘৃণা -গোলাম মোর্তোজা
রহস্যটা কী? তদন্ত কেন হয় না?
কেন নির্যাতিতের বিপক্ষে দাঁড়িয়ে অপরাধীদের পক্ষ নেয় প্রশাসন?
নারীরা বিশ্ববিদ্যালয়ে শারীরিকভাবে নির্যাতিত হচ্ছেন, প্রশাসন কোনো কোনো ক্ষেত্রে নির্বিকার থেকে অপরাধীদের পক্ষে থাকছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে কৌশলে অপরাধীকে নিরাপত্তা দিচ্ছে। অতীতের প্রায় সব কয়টি ঘটনার উদাহরণ যদি এখানে আনা হয়, তার প্রমাণ পাওয়া যাবে। এবারের পহেলা বৈশাখ উদযাপনের সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় নারীরা নির্যাতিত হলেন যৌন সন্ত্রাসীদের দ্বারা, বিস্ময়করভাবে দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার চেয়ে সবাই ব্যস্ত ঘটনা ধামাচাপা দিতে। কেন এই ধামাচাপা দেয়ার প্রবণতা আমাদের সংস্কৃতির অংশ করে ফেলছি? প্রশ্ন করলেই তারা সবাই বলেন, দোষীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। তাদের কার্যক্রম এবং বক্তব্য যে পরস্পর স্ববিরোধী, দু'একটি প্রসঙ্গ উল্লেখ করলেই তা পরিষ্কার হবে।
১. ঢাকার পুলিশ কমিশনার মোঃ আছাদুজ্জামান পহেলা বৈশাখের আগে বলেছিলেন, তিন স্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। পুরো এলাকা সিসিটিভি ক্যামেরার আওতায়। মানুষ আশ্বস্ত হয়েছিল পুলিশের এই বক্তব্যে।
২. নিরাপত্তার জন্যে বিভিন্ন জায়গায় ক্যামেরা লাগানো হয়। এক বা একাধিক জায়গায় বসে তা মনিটর করা হয়। এক ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে যৌন সন্ত্রাসীদের নির্যাতন চলল, ক্যামেরা মনিটরিংয়ের দায়িত্বে যে পুলিশ ছিল তারা কিছুই দেখল না! আসলে হয় মনিটরিংয়ের দায়িত্বে কেউ ছিল না অথবা যে বা যারা ছিল তারা দায়িত্ব পালন করেনি।
৩. ছাত্র ইউনিয়নের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি লিটন নন্দীরা প্রতিরোধ করার চেষ্টা করে আহত হয়েছেন। নিজের পাঞ্জাবি খুলে একজনের সম্মান বাঁচানোর চেষ্টা করেছেন। প্রক্টর আমজাদ আলীকে খবর দিয়েছেন, তিনি কর্ণপাত করেননি। পুলিশকে বলেছেন, পুলিশ নির্বিকার থেকেছে। আবার প্রক্টরের রুমে গেছেন, তখন তিনি কম্পিউটারে দাবা খেলছিলেন। কেন কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছেন না, কেন ঘটনাস্থলে গেলেন না? এমন প্রশ্নের উত্তরে প্রক্টর বলেন, 'আমি ওখানে গিয়েই বা কী করতাম।'
তাই তো, দাবা খেলা বাদ দিয়ে তিনি সেখানে যাবেন কেন!
৪. ঘটনার পরের দিন ভিসি আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বললেন, 'যারা এই ঘটনা ঘটিয়েছে তারা সবাই বহিরাগত...।'
এই কথা যখন তিনি বলছেন, তখন পর্যন্ত ভিডিও ফুটেজ প্রকাশিত হয়নি। কোনো তদন্ত তো হয়-ইনি। ভিসি জেনে গেলেন সবাই বহিরাগত!
৫. ছাত্র ইউনিয়নের পক্ষ থেকে আহ্বান জানানো হয়েছিল, কারও কাছে যদি তথ্যপ্রমাণ থাকে তা সরবরাহ করার জন্যে। একজন ছাত্র সাড়া দিয়েছিলেন, তার কাছে দু'টি ছবি ছিল। লিটন নন্দীরা তার কাছে ছবি চাইলে তিনি ফেসবুকে লেখেন, 'ভিসি স্যার বলেছেন, এই ছবি প্রকাশিত হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানহানি হবে। স্যার ছবি দিতে নিষেধ করেছেন। তাই ছবি দিতে পারছি না।'
এটা ভিডিও ফুটেজ প্রকাশিত হওয়ার আগের ঘটনা।
৬. ঘটনার পাঁচ দিন পরেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি নির্বিকার আচরণ করছে। নারী নিপীড়নের প্রতিবাদে বা বিচারের দাবিতে তারা একটি বিবৃতি পর্যন্ত দেয়নি। যেসব শিক্ষক রাজনৈতিক ইস্যুতে গরম গরম কথা বলেন, তারাও নিশ্চুপ।
ক্যাম্পাসের একক ইজারাদার ছাত্রলীগ সম্পূর্ণ নিশ্চুপ, যা রীতিমতো রহস্যজনক।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ চ্যানেল ২৪-এর একটি অনুষ্ঠানে বলেছেন, 'মেয়েদের রাত নয়টার পরে বাইরে থাকার দরকার কী?'যদিও এই ঘটনাটি ঘটেছে সন্ধ্যা সাতটার মধ্যে।
৭. পুলিশ দু'টি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। তার আগেই পুলিশের ডিসি জাহাঙ্গীর আলম বলে দিয়েছেন, 'এ পর্যন্ত কোনো নারীর বস্ত্র হরণের চিত্র পাওয়া যায়নি।'আবার বলা হচ্ছে, ৪ জন বা ৮ জনকে শনাক্ত করা হয়েছে ভিডিও ফুটেজ দেখে। পুলিশের সরবরাহ করা ভিডিও ফুটেজে নিপীড়নের দৃশ্য স্পষ্টভাবে বোঝা যাচ্ছে, দেখা যাচ্ছে। দেখা যাচ্ছে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করার দৃশ্য। আর ডিসি বলছেন 'বস্ত্রহরণের'চিত্র দেখা যায়নি! ডিসি সাহেব কী পুরো বস্ত্রহরণ দেখার প্রত্যাশা করছিলেন? এতটুকুতে কি তার কাছে, পুলিশের কাছে মনে হচ্ছে না যে, এটা নিপীড়ন-নির্যাতন? লিটন নন্দী যে পাঞ্জাবি খুলে একজনের সম্মান বাঁচানোর উদ্যোগ নিলেন, এটা কি পুলিশ বিশ্বাস করছে না?
৮. ওপরের এই বক্তব্য- ঘটনাক্রম বিশ্লেষণ করলে কিছু সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায়Ñ
ক. সবাই সবাইকে বাঁচিয়ে নিজেরা রক্ষা পেতে চাইছেন।
খ. তদন্ত ছাড়া সবাইকে 'বহিরাগত'বলে ভিসি নিজে বাঁচতে চাইছেন। দলীয় প্রক্টরকে বাঁচাতে চাইছেন। প্রক্টর বাঁচাতে চাইছেন ভিসিকে।
গ. একই সময়ে জগন্নাথ এবং জাহাঙ্গীরনগরে ছাত্রী লাঞ্ছিত করেছে ছাত্রলীগ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই নিপীড়নের ঘটনায়ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের নাম সামনে চলে আসতে পারে, এমন আশঙ্কায় পুরো ঘটনা চাপা দেয়ায় সহায়তা করার নীতি নিয়েছে ছাত্রলীগ।
ঘ. এমন কিছু সামনে চলে এলে বিব্রত হবে সরকার। সামনে সিটি করপোরেশন নির্বাচন। তার ওপর প্রভাব পড়তে পারে। সুতরাং ঘটনা চাপা দেয়াই সবচেয়ে উত্তম। শিক্ষক সমিতির নজিরবিহীন নীরবতার নেপথ্য কারণ এটাই।
ঙ. ভিসি, প্রক্টর, শিক্ষক সমিতি, ছাত্রলীগ 'সম্মানহানি'বাঁচানোর চেষ্টায় ধামাচাপার নীতি অনুসরণ করছেন।
চ. পুলিশও ঘটনার মোড় অন্যদিকে ঘুরিয়ে বা ধামাচাপা দিয়ে দিতে তৎপর। কারণ প্রকৃত তদন্ত হলে তাদের ওপর ব্যর্থতার বড় দায় পড়বে।
ছ. বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এবং পুলিশের কাজে ঝামেলা তৈরি করছে ছাত্র ইউনিয়ন এবং গণমাধ্যম, বিশেষ করে ফেসবুক। 'বাড়াবাড়ি'না করার চাপে ছাত্র ইউনিয়ন ইতিমধ্যে পড়েছে। সারা দেশে তাদের বিক্ষোভ কর্মসূচি করতে দিচ্ছে না সরকার।
৯. এত কিছুর পর এখন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এবং পুলিশ তদন্ত করে ব্যবস্থা নিতে চাইছে। পুলিশের তদন্তের মূলভিত্তি সিসিটিভি ক্যামেরার ভিডিও ফুটেজ। যেহেতু 'বস্ত্র হরণের'চিত্র পুলিশ পায়নি, সুতরাং তদন্ত কী হবে, অনুমান করতে কারোরই কষ্ট হওয়ার কথা নয়। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন আহ্বান করেছে যার কাছে যে তথ্য আছে, তা দিয়ে তদন্তে সহায়তা করতে। যারা নিপীড়নের শিকার হয়েছেন, সেই সব নারী বিশ্ববিদ্যালয়ের তদন্ত কমিটির কাছে এসে সাক্ষী দেবেন, এমনটাই প্রত্যাশা করছেন তদন্ত কমিটির কর্তারা!
নিজেদের এমন প্রশ্নবোধক ধামাচাপা দেয়ার, অস্বীকার করার ইমেজ তৈরি করে এমন প্রত্যাশা করা, বেশ মজার কৌতুকই বটে।
১০. তাহলে তদন্তের অবস্থা কী হবে? তদন্তে সেই সব তথ্যই পাওয়া যাবে, সবাই মিলে যা পেতে চাইছে। অর্থাৎ তদন্তে প্রায় কোনো নতুন তথ্য পাওয়া যাবে না। কোনো নিপীড়নের শিকার নারী অবিশ্বস্ত তদন্ত কমিটির সামনে আসবেন না, নির্যাতনের কাহিনী বলবেন না।
তদন্ত কমিটির কাজ অনেক সহজ হয়ে যাবে। তারা বলবে, প্রকৃত সাক্ষী পাওয়া যায়নি। নির্যাতিত কেউ তাদের কাছে এসে নির্যাতনের কাহিনী অর্থাৎ শরীরের কোথায়, কীভাবে, কয়জন হাত দিয়েছে, সেসব কথা বলেননি। তদন্তে আরও সময় লাগবে।
১১. পুলিশের তদন্তে কয়েকজনকে চিহ্নিত করা হবে। আবিষ্কার হতে পারে বাঙালি সংস্কৃতিবিরোধী মৌলবাদী-জঙ্গিগোষ্ঠীর অস্তিত্ব। ধরাও পড়তে পারে কয়েকজন। আর একটি ঘটনা সামনে এলে পুলিশের তদন্ত, বিশ্ববিদ্যালয়ের তদন্ত সবই চাপা পড়ে যাবে। যেভাবে চাপা পড়ে গিয়েছিল জাহাঙ্গীরনগরের ছাত্রলীগের ধর্ষণের 'সেঞ্চুরি'মানিকের ঘটনা। কয়েকদিন আগের শহীদুল্লাহ হলের পুকুর পাড়ের সেই নির্যাতনের ঘটনাও তো আমরা মনে রাখিনি। যেখানে ছাত্রলীগ কর্মীরা কানাডা থেকে আসা সাবেক ছাত্রীকে নিপীড়ন করল। ছাত্রলীগের ঘটানো এবারের জাহাঙ্গীরনগর, জগন্নাথের ছাত্রী নিপীড়নের বিষয়ও আমরা মনে রাখব না।
কুমিল্লায় ছাত্রলীগ কর্তৃক ছাত্রলীগ নেতা হত্যা, হাজী দানেশে ছাত্রলীগের দুই হত্যাকাণ্ড, আওয়ামী লীগ এমপি কর্তৃক রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিকে লাঞ্ছনা... কোনো কিছুই আমাদের মনে থাকবে না। আমরা ব্যস্ত থাকব প্রতিনিয়ত ঘটা নতুন নতুন ঘটনা নিয়ে।
প্রশ্ন করলে ছাত্রলীগ বাহাদুরি নিয়ে বলে, আমরা সংগঠন থেকে বহিষ্কার করেছি, ব্যবস্থা নিয়েছি। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন 'সাময়িক'বহিষ্কার করে। আসলে সংগঠন থেকে বহিষ্কারের পরও তারা ছাত্রলীগেই থাকে। সাময়িক বহিষ্কারের পরও তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রই থাকে, পরীক্ষা দেয়Ñ কোনো কিছুতেই কোনো সমস্যা হয় না।
১২. যারা পহেলা বৈশাখ উদযাপনের বিরুদ্ধে, বাঙালি সংস্কৃতিবিরোধী, মৌলবাদী-জঙ্গি, তারাই ঘটিয়েছে এই ঘটনা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনার প্রেক্ষিতে অনেকেরই এমন মন্তব্য দেখছি, শুনছি। তর্কের খাতিরে ধরে নিলাম, এরাই এই অপকর্ম করেছে।
প্রশ্ন হলো, ভিসি, প্রক্টর, শিক্ষক সমিতি, পুলিশ সবাই মিলে ঘটনা ধামাচাপা দিতে চাইছে কেন? কেন ছাত্র ইউনিয়নের প্রতিবাদে বাধা দেয়া হচ্ছে? রাত নয়টার পরে মেয়েদের বাইরে না থাকার কথা তো হেফাজত-জঙ্গি-মৌলবাদীরা বলে। ঢাবির দলান্ধ কোষাধ্যক্ষ এমন কথা বলছেন কেন? বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন, রাষ্ট্রীয় প্রশাসন সবাই কি তাহলে এই অপশক্তির পৃষ্ঠপোষক?
১৩. সেই পুরনো কথা। হাতি জঙ্গলে মুখ লুকিয়ে ভাবে, তাকে কেউ দেখছে না। আসলে হাতির পুরো উলঙ্গ শরীর দেখা যায়। ধামাচাপা দেয়ার এবারের কৌশল বড় বেশি রকমের স্পষ্ট হয়ে গেছে জনমানুষের সামনে।
১৪. পুলিশের সরবরাহ করা ভিডিও ফুটেজ একাত্তর টেলিভিশনে তার অনুষ্ঠানে প্রচার করেছে ফারজানা রূপা। এর প্রেক্ষিতে 'আনসারুল্লাহ বাংলা'তাকে এবং তার পরিবারকে হত্যার হুমকি দিয়েছে। হুমকিকে হালকাভাবে নেয়ার সুযোগ নেই। তাদের নিরাপত্তা অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে। আর তদন্ত হওয়া দরকার নির্মোহভাবে। প্রকৃত ঘটনা অন্যদিকে ঘুরিয়ে দেয়ার কৌশল কি না, সেটা গুরুত্ব দিয়ে অনুসন্ধান হওয়া দরকার। আদৌ 'আনসারুল্লাহ বাংলা'হুমকি দিল কি না, নাকি অন্য কেউ, অন্য কোনো শক্তি এই নাম ব্যবহার করল, সেটা নিশ্চিত হওয়া জরুরি। কাজটি করতে হবে সরকারকে। প্রকৃত-বিশ্বাসযোগ্য তদন্ত না হলে 'অবিশ্বাস্য''অদৃশ্য''বায়বীয় অস্তিত্বহীন'কোনো শক্তির ওপর দায় চাপানো যাবে, চাপানোর চেষ্টা করা যাবে। মানুষকে বিশ্বাস করানো যাবে না। আইনের থেকে নিজেরা বাঁচা যাবে, প্রকৃত অপরাধীকে বাঁচানোও যাবে। মানুষের ঘৃণা থেকে বাঁচা যাবে না।
http://www.shaptahik.com/v2/?DetailsId=10169
রহস্যটা কী? তদন্ত কেন হয় না?
কেন নির্যাতিতের বিপক্ষে দাঁড়িয়ে অপরাধীদের পক্ষ নেয় প্রশাসন?
নারীরা বিশ্ববিদ্যালয়ে শারীরিকভাবে নির্যাতিত হচ্ছেন, প্রশাসন কোনো কোনো ক্ষেত্রে নির্বিকার থেকে অপরাধীদের পক্ষে থাকছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে কৌশলে অপরাধীকে নিরাপত্তা দিচ্ছে। অতীতের প্রায় সব কয়টি ঘটনার উদাহরণ যদি এখানে আনা হয়, তার প্রমাণ পাওয়া যাবে। এবারের পহেলা বৈশাখ উদযাপনের সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় নারীরা নির্যাতিত হলেন যৌন সন্ত্রাসীদের দ্বারা, বিস্ময়করভাবে দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার চেয়ে সবাই ব্যস্ত ঘটনা ধামাচাপা দিতে। কেন এই ধামাচাপা দেয়ার প্রবণতা আমাদের সংস্কৃতির অংশ করে ফেলছি? প্রশ্ন করলেই তারা সবাই বলেন, দোষীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। তাদের কার্যক্রম এবং বক্তব্য যে পরস্পর স্ববিরোধী, দু'একটি প্রসঙ্গ উল্লেখ করলেই তা পরিষ্কার হবে।
১. ঢাকার পুলিশ কমিশনার মোঃ আছাদুজ্জামান পহেলা বৈশাখের আগে বলেছিলেন, তিন স্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। পুরো এলাকা সিসিটিভি ক্যামেরার আওতায়। মানুষ আশ্বস্ত হয়েছিল পুলিশের এই বক্তব্যে।
২. নিরাপত্তার জন্যে বিভিন্ন জায়গায় ক্যামেরা লাগানো হয়। এক বা একাধিক জায়গায় বসে তা মনিটর করা হয়। এক ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে যৌন সন্ত্রাসীদের নির্যাতন চলল, ক্যামেরা মনিটরিংয়ের দায়িত্বে যে পুলিশ ছিল তারা কিছুই দেখল না! আসলে হয় মনিটরিংয়ের দায়িত্বে কেউ ছিল না অথবা যে বা যারা ছিল তারা দায়িত্ব পালন করেনি।
৩. ছাত্র ইউনিয়নের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি লিটন নন্দীরা প্রতিরোধ করার চেষ্টা করে আহত হয়েছেন। নিজের পাঞ্জাবি খুলে একজনের সম্মান বাঁচানোর চেষ্টা করেছেন। প্রক্টর আমজাদ আলীকে খবর দিয়েছেন, তিনি কর্ণপাত করেননি। পুলিশকে বলেছেন, পুলিশ নির্বিকার থেকেছে। আবার প্রক্টরের রুমে গেছেন, তখন তিনি কম্পিউটারে দাবা খেলছিলেন। কেন কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছেন না, কেন ঘটনাস্থলে গেলেন না? এমন প্রশ্নের উত্তরে প্রক্টর বলেন, 'আমি ওখানে গিয়েই বা কী করতাম।'
তাই তো, দাবা খেলা বাদ দিয়ে তিনি সেখানে যাবেন কেন!
৪. ঘটনার পরের দিন ভিসি আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বললেন, 'যারা এই ঘটনা ঘটিয়েছে তারা সবাই বহিরাগত...।'
এই কথা যখন তিনি বলছেন, তখন পর্যন্ত ভিডিও ফুটেজ প্রকাশিত হয়নি। কোনো তদন্ত তো হয়-ইনি। ভিসি জেনে গেলেন সবাই বহিরাগত!
৫. ছাত্র ইউনিয়নের পক্ষ থেকে আহ্বান জানানো হয়েছিল, কারও কাছে যদি তথ্যপ্রমাণ থাকে তা সরবরাহ করার জন্যে। একজন ছাত্র সাড়া দিয়েছিলেন, তার কাছে দু'টি ছবি ছিল। লিটন নন্দীরা তার কাছে ছবি চাইলে তিনি ফেসবুকে লেখেন, 'ভিসি স্যার বলেছেন, এই ছবি প্রকাশিত হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানহানি হবে। স্যার ছবি দিতে নিষেধ করেছেন। তাই ছবি দিতে পারছি না।'
এটা ভিডিও ফুটেজ প্রকাশিত হওয়ার আগের ঘটনা।
৬. ঘটনার পাঁচ দিন পরেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি নির্বিকার আচরণ করছে। নারী নিপীড়নের প্রতিবাদে বা বিচারের দাবিতে তারা একটি বিবৃতি পর্যন্ত দেয়নি। যেসব শিক্ষক রাজনৈতিক ইস্যুতে গরম গরম কথা বলেন, তারাও নিশ্চুপ।
ক্যাম্পাসের একক ইজারাদার ছাত্রলীগ সম্পূর্ণ নিশ্চুপ, যা রীতিমতো রহস্যজনক।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ চ্যানেল ২৪-এর একটি অনুষ্ঠানে বলেছেন, 'মেয়েদের রাত নয়টার পরে বাইরে থাকার দরকার কী?'যদিও এই ঘটনাটি ঘটেছে সন্ধ্যা সাতটার মধ্যে।
৭. পুলিশ দু'টি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। তার আগেই পুলিশের ডিসি জাহাঙ্গীর আলম বলে দিয়েছেন, 'এ পর্যন্ত কোনো নারীর বস্ত্র হরণের চিত্র পাওয়া যায়নি।'আবার বলা হচ্ছে, ৪ জন বা ৮ জনকে শনাক্ত করা হয়েছে ভিডিও ফুটেজ দেখে। পুলিশের সরবরাহ করা ভিডিও ফুটেজে নিপীড়নের দৃশ্য স্পষ্টভাবে বোঝা যাচ্ছে, দেখা যাচ্ছে। দেখা যাচ্ছে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করার দৃশ্য। আর ডিসি বলছেন 'বস্ত্রহরণের'চিত্র দেখা যায়নি! ডিসি সাহেব কী পুরো বস্ত্রহরণ দেখার প্রত্যাশা করছিলেন? এতটুকুতে কি তার কাছে, পুলিশের কাছে মনে হচ্ছে না যে, এটা নিপীড়ন-নির্যাতন? লিটন নন্দী যে পাঞ্জাবি খুলে একজনের সম্মান বাঁচানোর উদ্যোগ নিলেন, এটা কি পুলিশ বিশ্বাস করছে না?
৮. ওপরের এই বক্তব্য- ঘটনাক্রম বিশ্লেষণ করলে কিছু সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায়Ñ
ক. সবাই সবাইকে বাঁচিয়ে নিজেরা রক্ষা পেতে চাইছেন।
খ. তদন্ত ছাড়া সবাইকে 'বহিরাগত'বলে ভিসি নিজে বাঁচতে চাইছেন। দলীয় প্রক্টরকে বাঁচাতে চাইছেন। প্রক্টর বাঁচাতে চাইছেন ভিসিকে।
গ. একই সময়ে জগন্নাথ এবং জাহাঙ্গীরনগরে ছাত্রী লাঞ্ছিত করেছে ছাত্রলীগ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই নিপীড়নের ঘটনায়ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের নাম সামনে চলে আসতে পারে, এমন আশঙ্কায় পুরো ঘটনা চাপা দেয়ায় সহায়তা করার নীতি নিয়েছে ছাত্রলীগ।
ঘ. এমন কিছু সামনে চলে এলে বিব্রত হবে সরকার। সামনে সিটি করপোরেশন নির্বাচন। তার ওপর প্রভাব পড়তে পারে। সুতরাং ঘটনা চাপা দেয়াই সবচেয়ে উত্তম। শিক্ষক সমিতির নজিরবিহীন নীরবতার নেপথ্য কারণ এটাই।
ঙ. ভিসি, প্রক্টর, শিক্ষক সমিতি, ছাত্রলীগ 'সম্মানহানি'বাঁচানোর চেষ্টায় ধামাচাপার নীতি অনুসরণ করছেন।
চ. পুলিশও ঘটনার মোড় অন্যদিকে ঘুরিয়ে বা ধামাচাপা দিয়ে দিতে তৎপর। কারণ প্রকৃত তদন্ত হলে তাদের ওপর ব্যর্থতার বড় দায় পড়বে।
ছ. বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এবং পুলিশের কাজে ঝামেলা তৈরি করছে ছাত্র ইউনিয়ন এবং গণমাধ্যম, বিশেষ করে ফেসবুক। 'বাড়াবাড়ি'না করার চাপে ছাত্র ইউনিয়ন ইতিমধ্যে পড়েছে। সারা দেশে তাদের বিক্ষোভ কর্মসূচি করতে দিচ্ছে না সরকার।
৯. এত কিছুর পর এখন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এবং পুলিশ তদন্ত করে ব্যবস্থা নিতে চাইছে। পুলিশের তদন্তের মূলভিত্তি সিসিটিভি ক্যামেরার ভিডিও ফুটেজ। যেহেতু 'বস্ত্র হরণের'চিত্র পুলিশ পায়নি, সুতরাং তদন্ত কী হবে, অনুমান করতে কারোরই কষ্ট হওয়ার কথা নয়। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন আহ্বান করেছে যার কাছে যে তথ্য আছে, তা দিয়ে তদন্তে সহায়তা করতে। যারা নিপীড়নের শিকার হয়েছেন, সেই সব নারী বিশ্ববিদ্যালয়ের তদন্ত কমিটির কাছে এসে সাক্ষী দেবেন, এমনটাই প্রত্যাশা করছেন তদন্ত কমিটির কর্তারা!
নিজেদের এমন প্রশ্নবোধক ধামাচাপা দেয়ার, অস্বীকার করার ইমেজ তৈরি করে এমন প্রত্যাশা করা, বেশ মজার কৌতুকই বটে।
১০. তাহলে তদন্তের অবস্থা কী হবে? তদন্তে সেই সব তথ্যই পাওয়া যাবে, সবাই মিলে যা পেতে চাইছে। অর্থাৎ তদন্তে প্রায় কোনো নতুন তথ্য পাওয়া যাবে না। কোনো নিপীড়নের শিকার নারী অবিশ্বস্ত তদন্ত কমিটির সামনে আসবেন না, নির্যাতনের কাহিনী বলবেন না।
তদন্ত কমিটির কাজ অনেক সহজ হয়ে যাবে। তারা বলবে, প্রকৃত সাক্ষী পাওয়া যায়নি। নির্যাতিত কেউ তাদের কাছে এসে নির্যাতনের কাহিনী অর্থাৎ শরীরের কোথায়, কীভাবে, কয়জন হাত দিয়েছে, সেসব কথা বলেননি। তদন্তে আরও সময় লাগবে।
১১. পুলিশের তদন্তে কয়েকজনকে চিহ্নিত করা হবে। আবিষ্কার হতে পারে বাঙালি সংস্কৃতিবিরোধী মৌলবাদী-জঙ্গিগোষ্ঠীর অস্তিত্ব। ধরাও পড়তে পারে কয়েকজন। আর একটি ঘটনা সামনে এলে পুলিশের তদন্ত, বিশ্ববিদ্যালয়ের তদন্ত সবই চাপা পড়ে যাবে। যেভাবে চাপা পড়ে গিয়েছিল জাহাঙ্গীরনগরের ছাত্রলীগের ধর্ষণের 'সেঞ্চুরি'মানিকের ঘটনা। কয়েকদিন আগের শহীদুল্লাহ হলের পুকুর পাড়ের সেই নির্যাতনের ঘটনাও তো আমরা মনে রাখিনি। যেখানে ছাত্রলীগ কর্মীরা কানাডা থেকে আসা সাবেক ছাত্রীকে নিপীড়ন করল। ছাত্রলীগের ঘটানো এবারের জাহাঙ্গীরনগর, জগন্নাথের ছাত্রী নিপীড়নের বিষয়ও আমরা মনে রাখব না।
কুমিল্লায় ছাত্রলীগ কর্তৃক ছাত্রলীগ নেতা হত্যা, হাজী দানেশে ছাত্রলীগের দুই হত্যাকাণ্ড, আওয়ামী লীগ এমপি কর্তৃক রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিকে লাঞ্ছনা... কোনো কিছুই আমাদের মনে থাকবে না। আমরা ব্যস্ত থাকব প্রতিনিয়ত ঘটা নতুন নতুন ঘটনা নিয়ে।
প্রশ্ন করলে ছাত্রলীগ বাহাদুরি নিয়ে বলে, আমরা সংগঠন থেকে বহিষ্কার করেছি, ব্যবস্থা নিয়েছি। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন 'সাময়িক'বহিষ্কার করে। আসলে সংগঠন থেকে বহিষ্কারের পরও তারা ছাত্রলীগেই থাকে। সাময়িক বহিষ্কারের পরও তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রই থাকে, পরীক্ষা দেয়Ñ কোনো কিছুতেই কোনো সমস্যা হয় না।
১২. যারা পহেলা বৈশাখ উদযাপনের বিরুদ্ধে, বাঙালি সংস্কৃতিবিরোধী, মৌলবাদী-জঙ্গি, তারাই ঘটিয়েছে এই ঘটনা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনার প্রেক্ষিতে অনেকেরই এমন মন্তব্য দেখছি, শুনছি। তর্কের খাতিরে ধরে নিলাম, এরাই এই অপকর্ম করেছে।
প্রশ্ন হলো, ভিসি, প্রক্টর, শিক্ষক সমিতি, পুলিশ সবাই মিলে ঘটনা ধামাচাপা দিতে চাইছে কেন? কেন ছাত্র ইউনিয়নের প্রতিবাদে বাধা দেয়া হচ্ছে? রাত নয়টার পরে মেয়েদের বাইরে না থাকার কথা তো হেফাজত-জঙ্গি-মৌলবাদীরা বলে। ঢাবির দলান্ধ কোষাধ্যক্ষ এমন কথা বলছেন কেন? বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন, রাষ্ট্রীয় প্রশাসন সবাই কি তাহলে এই অপশক্তির পৃষ্ঠপোষক?
১৩. সেই পুরনো কথা। হাতি জঙ্গলে মুখ লুকিয়ে ভাবে, তাকে কেউ দেখছে না। আসলে হাতির পুরো উলঙ্গ শরীর দেখা যায়। ধামাচাপা দেয়ার এবারের কৌশল বড় বেশি রকমের স্পষ্ট হয়ে গেছে জনমানুষের সামনে।
১৪. পুলিশের সরবরাহ করা ভিডিও ফুটেজ একাত্তর টেলিভিশনে তার অনুষ্ঠানে প্রচার করেছে ফারজানা রূপা। এর প্রেক্ষিতে 'আনসারুল্লাহ বাংলা'তাকে এবং তার পরিবারকে হত্যার হুমকি দিয়েছে। হুমকিকে হালকাভাবে নেয়ার সুযোগ নেই। তাদের নিরাপত্তা অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে। আর তদন্ত হওয়া দরকার নির্মোহভাবে। প্রকৃত ঘটনা অন্যদিকে ঘুরিয়ে দেয়ার কৌশল কি না, সেটা গুরুত্ব দিয়ে অনুসন্ধান হওয়া দরকার। আদৌ 'আনসারুল্লাহ বাংলা'হুমকি দিল কি না, নাকি অন্য কেউ, অন্য কোনো শক্তি এই নাম ব্যবহার করল, সেটা নিশ্চিত হওয়া জরুরি। কাজটি করতে হবে সরকারকে। প্রকৃত-বিশ্বাসযোগ্য তদন্ত না হলে 'অবিশ্বাস্য''অদৃশ্য''বায়বীয় অস্তিত্বহীন'কোনো শক্তির ওপর দায় চাপানো যাবে, চাপানোর চেষ্টা করা যাবে। মানুষকে বিশ্বাস করানো যাবে না। আইনের থেকে নিজেরা বাঁচা যাবে, প্রকৃত অপরাধীকে বাঁচানোও যাবে। মানুষের ঘৃণা থেকে বাঁচা যাবে না।
http://www.shaptahik.com/v2/?DetailsId=10169