উদারীকরণ গণতন্ত্রের সবথেকে বড় বিপদঃ শরদিন্দু উদ্দীপন
বাজারি অর্থনীতির হাত ধরে গোটা বিশ্ব এখন কতিপয় প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গের হাতের মুঠোর মধ্যে এসে পড়েছে। অর্থাৎ এই মুষ্টিমেয় মানুষের ইচ্ছা বা অনিচ্ছার উপরই নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে গোটা বিশ্বের মানুষের ভবিষ্যৎ। এরাই নিয়ন্ত্রন করছে রাষ্ট্র। এরাই লালন-পালন ও ধ্বংসের সর্বময় কর্তা হয়ে উঠেছে। এরাই চালক, এরাই নিয়ন্ত্রক। এদের মর্জির উপরই নির্ভর করেই হচ্ছে রাজনৈতিক দলগুলির উত্থান ও পতন। অর্থাৎ আর্থিক সংস্কারের ও উদারীকরণের এই বাজারমুখী প্রবণতা গণতন্ত্রকেই শিকেয় তুলে ছাড়ছে। মানুষের হাতের সম্পদ বাজারপ্রভুদের চকচকে মোড়কে পাইকেরি হারে বিক্রি হচ্ছে ভুবনডাঙার খোলা হাটে।
উদারনৈতিক এই বাজারি দর্শনই গণতন্ত্রের এখন সবথেকে বড় বিপদ। বিগত কয়েক দশক ধরে সর্বময় প্রভুদের এই বাজারি দর্শন ক্রমান্বয়ে গণতন্ত্রকে পিষে ফেলে কায়েমীতন্ত্রে পরিণত করে ফেলেছে। এতে পুঁজির বাড়বাড়ন্ত হলেও গণতন্ত্রের যে আসল ভিত্তি ও উপভোক্তা "জনগণ"তারাই অপাংক্তেয় হয়ে পড়েছে।
সাম্প্রতি গণতন্ত্রের অন্যতম পীঠস্থান আমেরিকার ১৮০০টি পলিসির উপর একটি অনন্য গবেষণার থেকে এমনি তথ্য পাওয়া গেছে যে শীঘ্রই অ্যামেরিকার গণতন্ত্র ধ্বংস হয়ে কায়েমীতন্ত্র শুরু হবে। ১৯৮১ থেকে ২০০২ সংগৃহীত এই তথ্যগুলি থেকে জানা যাচ্ছে যে অ্যামেরিকার কতিপয় সংগঠিত এলিট সম্প্রদায়ের লাভালাভের ভিত্তিতেই সেখানকার সরকারি পলিসিগুলি নির্ধারণ করা হয় যেখানে বিপুল জনসংখ্যার কোন প্রভাব পরিলক্ষিত হয় না। গবেষক মার্টিন ও বেঞ্জামিন এই রিপোর্টে উল্লেখ করেন যে এই সময়ের মধ্যে রিপাবলিকান পার্টি বা ডেমোক্রেটিক পার্টি যারাই ক্ষমতায় আসুক না কেন এই কতিপয় এলিট সমাজই রাষ্ট্রের ৯০শতাংশ পলিসির নিয়ন্ত্রক। গবেষণা পত্রের মূল্যায়নে তাই তারা অ্যামেরিকায় গণতন্ত্র ধ্বংস হয়ে যাবার আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন।
মুষ্টিমেয় বিত্তশালীর হাতে এভাবে ক্ষমতা পুঞ্জীভূত হওয়ার কারণে ব্যাপক মানুষের ক্ষোভ আছড়ে পড়েছিল অকুপাই ওয়াল ষ্ট্রীটের আন্দোলনের মাধ্যমে। আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় জনগণের ভাগিদারী যে ভাবে সংকুচিত হয়েছে এবং সমস্ত ক্ষমতা ও সম্পদ যেভাবে অল্প কিছু সংখ্যক মানুষের হাতে কেন্দ্রীভূত হয়েছে অকুপাই ওয়াল ষ্ট্রীটের আন্দোলন তার প্রতি অনাস্থাই ব্যক্ত করেছিল। এই অনাস্থার তীব্র প্রতিবাদ ডিসেম্বর ২০১৩ সালে ইন্দোনেশিয়ার বালিতে আয়োজিত ওয়ার্ল্ড ট্রেড অর্গানাইজেশন মিনিস্টেরিয়াল কনফারেন্সকেও প্রভাবিত করেছিল। আন্দোলনকর্মীরা সহস্র বাঁধা অতিক্রম করে বালিতে গিয়েও বাজার প্রভূদের তীব্র ধিক্কার জানিয়েছিল।
যে পুঁজিবাদ বা উদারীকরণের নীতির ফলে অ্যামেরিকার গণতন্ত্র আজ খাদের কিনারায় এসে দাঁড়িয়েছে এবং যে মুহূর্তে অ্যামেরিকার জনগণ গণতন্ত্রের রক্ষার জন্য চিন্তিত ঠিক সেই মুহূর্তে ভারতবর্ষকে ভূবনডাঙার পাইকেরি বাজারে তুলে দেবার জন্য তুরিভেরি বাজিয়ে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র দামোদর দাস মোদি। সমীকরণ সেই একটিই। রাজনীতিতে ভারতীয় বিত্তশালীদের প্রভাব বিস্তার করা। রাজনৈতিক দলগুলির মধ্য দিয়ে বাজারের উপযুক্ত পলিসি তৈরি করা এবং জনগণের প্রভাবকে সংকুচিত করে সমস্ত সম্পদের উপর নিজেদের দখলদারী প্রতিষ্ঠিত করা। ইতিমধ্যেই রিলায়েন্স সহ অন্যান্য বাজারপ্রভূদের সাথে তার যে মধুর সম্পর্ক গড়ে উঠেছে এবং যে ভাবে বিশ্ববাজারিরা ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য উন্মুখ হয়ে উঠেছে তাতে অচিরেই ভারতবর্ষে অ্যামেরিকা সিন্ড্রোম তৈরি হবে। পণ্যমূল্যে নির্ধারিত হবে ভারতীয় মূল্যবোধ। আর এই মূল্যবোধের নিরিখেই "শাইনিং ইন্ডিয়া"র রূপান্তর ঘটবে "স্বচ্ছ ভারতে"।