দুর্গা রূপেনঃ সংস্থিতাঃ
শরদিন্দু বিশ্বাস
ভারতীয় ইতিহাসে অসুরভাষী রাজাদের শাসনে নারীকে সমান ভাবে মর্যাদা দোওয়া হয়েছে তার ইতিহাস নান সূত্র থেকে আমরা পাই। মূলতঃ মাতৃতান্ত্রিক সমাজের মাধুর্যতায় গড়ে উঠেছিল ভারতের কৌম সমাজের ভিত। আর অসুর রাজারা তাকে মান্যতা দিয়ে গড়ে তুলেছিল বিভিন্ন জনপদ। সাওতাল সমাজের জোম–সিম-বিন্তির মধ্যে মানব সমাজের বিবর্তনে পিলচু হড়াম ও পিলচু বা বুড়িকে সমান গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে, বরং নারীর ইচ্ছাকেই সৃষ্টির প্রেরণা হিসেবে দেখানো হয়েছে এই সব বিন্তিগুলিতে। হরপ্পার (আদি অস্ট্রিক শব্দ, যা হড় ও হপ্পন দুটি শব্দের সমাহার) খননকার্যে যে প্রত্ন নিদর্শনগুলি উঠে এসেছে তাতে নিশ্চিত ভাবে প্রমাণিত হয় যে সেকালে নারীকে পুরুষের সাথে সমান গুরুত্ব দেওয়া হত। হরপ্পায় মাতৃ মূর্তিগুলি শৈল্পিক ভাবনায় অনন্য। মহামতি গোতমা বুদ্ধের সময় ভিক্ষুনী সংঘ গড়ে ওঠে। মাতা গোতমীর নেতৃত্বে ৫০০ শতাধিক নারী প্রবজ্জা গ্রহণ করেন। প্রতিষ্ঠিত হয় ভিক্ষুনী সংঘ। ভিক্ষুদের মতই ভিক্ষুনীরা সমান মর্যাদায় ধম্ম প্রচারের সর্বোচ্চ সম্মান পান। নারী পুরুষের সমমর্যাদা ও সমানধিকার প্রতিষ্ঠার এটাই সর্বপ্রথম নিদর্শন। এই নারীদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় লেখা "থেরীগাঁথা"যা বুদ্ধ সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ সম্পদ। বুদ্ধের অন্যতম অনুগামী "তারা"তার জীবিত কালেই বুদ্ধের সমান খ্যাতি অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। কালচক্রযানী, প্রজ্ঞা ও পারমিতার সুষম অভিধায় ভূষিতা 'তারা'তিব্বত, চীন, জাপান ও দক্ষিণপূর্ব দীপ রাষ্ট্রগুলিতে বুদ্ধের মতই আদরণীয়া। নারীর সৃজনে ও মননে আপন মহিমায় বিকশিত হওয়ার অনন্য প্রতীক এই 'তারা'।
বৈদিক যুগে নারীর অধিকারঃ
বৈদিক সমাজের প্রথম দিকেও নারীর বিভিন্ন সামাজিক অধিক স্বীকার করা হয়েছিল। ঘোষা, লোপামূদ্রা, মৈত্রেই ও গার্গীর মত মহীয়সী নারীরা বেদের শ্লোক রচনার কাজেও অবদান রাখতে পেরেছিলেন। সামাজিক নানা কাজে নারীদের স্বতন্ত্র ভুমিকা মেনে নিয়েছিল বৈদিক সমাজ। নিজের ইচ্ছায় তারা পুরুষ সঙ্গী নির্বাচন করতে পারত, এমনকি বিধবাদের পুনর্বিবাহের স্বীকৃতিও ছিল। "Women enjoyed far greater freedom in the Vedic period than in later India. She had more to say in the choice of her mate than the forms of marriage might suggest. She appeared freely at feasts and dances, and joined with men in religious sacrifice. She could study, and like Gargi, engage in philosophical disputation. If she was left a widow there was no restrictions upon her remarriage." Will Durant - Story of Civilization: Our Oriental Heritage.
তবে পরবর্তী কালে নারীর সমস্ত অধিকার কেড়ে নেওয়া হল কেন? বিশেষত মনুর কাল থেকে নারীকে কেন পশু ও শূদ্রের পর্যায়ে নামিয়ে দেওয়া হল? "একজন বালিকা বা যুবতী বা বৃদ্ধা গৃহে স্বাধীন ভাবে কিছু করবেনা। স্ত্রীলোক বাল্যে পিতার বশ্য থাকবে, যৌবনে স্বামীর অধীনে, স্বামী প্রেতলোক প্রাপ্ত হলে পুত্রের অধীনে থাকবে। কোন পরিস্থিতিতে নারী স্বাধীন থাকবে না'।
(মনুস্মৃতি, ৫/১৪৭-১৫০)
অথবা "mam hi partha vyapasrit ya
ye 'pi syuh papa-yonayah
striyo vaisyas tatha sudras
te 'pi yanti param gatim"…… Bhagvat Gita, Chapter Nine text 32
"নারী, বৈশ্য এবং শূদ্রগণ পাপ যোনিতে জন্ম"।
ব্রাহ্মণ্য সাহিত্যের পরতে পরতে নারীর প্রতি এই বিদ্বেষ জন্মেছিল কোন কারণে? এই বিদ্বেষ কি ব্রাহ্মন্যবাদের স্বাভাবিক নিয়ম? নাকি শিকারজীবি যাযাবরদের ভোগ্য বস্তু সংগ্রহের মত নারীও ছিল তাদের ভোগের বস্তু? ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে কিন্তু এটাই প্রমান হিসেবে উঠে আসছে যে অসুর রাজাদের সম্পদ লুন্ঠনের সাথে সাথে তাদের নারীদের লুণ্ঠনও ছিল বর্বর আর্যদের অন্যতম লালসা। নারীদের বন্দী করা। তাদের সেনা শিবিরে বা দুর্গে নিয়ে গিয়ে যার যেমন খুশি যৌন ক্ষুধা মেটানোর লালসা। মূলত আর্য সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে সব থেকে বেশি নির্যাতনের শিকার হয়েছে নারী।
বেদের দশম মণ্ডলের পর বতুর্বর্ণ ব্যবস্থা সুদৃঢ় হলে ক্ষমতার বলেই বর্ণশ্রেষ্ঠ ব্রহ্মনেরা সব থেকে বেশী লাভবান হয়। এই সময় থেকেই শুরু হয় দেবায়নের প্রক্রিয়া। দেবশক্তি হিসেবে ব্রাহ্মনেরাই ক্ষমতার শীর্ষে অধিষ্ঠিত হয়। আর্য বা বৈদিক সমাজের বল্গাহীন শারীরিক সুখ ভোগের আকাঙ্ক্ষা তাদের ধর্ম অর্থ কাম ও মোক্ষের সাথে এমন ভাবে একাকার হয়ে যায় একে সার্বিক বৈধতা দিতে হয়। ধর্মের নামে, রীতিনীতির নামে, লোকাচারের নামে ব্যাভিচার হয়ে ওঠে সর্বত্রগামী। নারী পুরুষ নির্বিশেষে জৈবিক সুখ ভোগের প্লাবনে সমাজকে ভাসিয়ে দিতে চায় ব্রাহ্মণ্য দর্শন। এই দুর্দম্য লালসাকে সুরক্ষা ও বৈধতা দেওয়ার জন্য বৈদিক কাল থেকেই চলে নিরন্তর প্রয়াস। বেদ, ব্রাহ্মণ, পুরাণ, উপনিষদ এমনকি রামায়ণ ও মহাভারত কাব্যকে ব্যবহার করে চলে ব্যাপক প্রচার। ভোগবাদ ও যৌনাচারের এই প্রচার ও প্রসার এমন পর্যায়ে চলে যায় যে যৌন সঙ্গী নির্বাচনের ক্ষেত্রে মা, মেয়ে, ভাই, বোন প্রভৃতি বাঁধ বিচারের বাঁধন ধ্বংস হয়ে যায়। শতপথ ব্রাহ্মণ ও সরস্বতী পুরানে ব্রাহ্মাকে তার নিজের কন্যা সরস্বতীর সাথে যৌনাচারে লিপ্ত হতে দেখা যায় এবং এই যৌন মিলনে যে সন্তানের জন্ম হয় তার নাম স্বয়ম্ভূ মনু। মনু আবার তার মা সরস্বতীকে সম্ভোগ করে এবং তাদের একাধিক সন্তানের জন্ম হয়। নারী পুরুষ নির্বিশেষে এই বহুগামিতা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে সত্যাকাম গুরু গৌতমের কাছে তার নিজের পিতার নাম বা গোত্র বলতে পারেনি। সত্য কামের মা জবালাও বলতে পারেনি কোন পুরুষ সত্যকামের আসল পিতা। দেবারত পুত্র শিশু যাজ্ঞবল্ককে কোলের থেকে নামিয়ে তার মা অন্য ঋষির সাথে সহবাস করতে বাধ্য হয়েছিল এমন কাহিনী আমরা যাজ্ঞবল্ক স্মৃতিতেই দেখতে পাই। অর্থাৎ দেবতার নামে, ঈশ্বরের নামে সামাজিক রীতিনীতির নামে নারীকেই নিষ্পেষণের সহজ ক্ষেত্র হিসেবে চিহ্নিত করেছিল ব্রাহ্মন্যবাদ।
উত্তরকালে নারীদের উপর এই আধিপত্যবাদের চরম পরিণতি হিসেবে শুরু হয় পতিতাবৃত্তি, বাল্য বিবাহ, বহুবিবাহ, দেবদাসী ও সতী প্রথা। এবং এই সমস্ত কাদাচারই একটি বৃত্তকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়েছে। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের বহুবিবাহ এবং সম্বন্ধ নির্ণয় গ্রন্থে কুল রক্ষার নামে একজন কুলিন ব্রাহ্মণ যে একাধিক বিবাহ করতেন তার তালিকা তুলে ধরেছেন। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তার বিভিন্ন উপন্যাসে নারীদের উপর যে কী নিষ্ঠুর সামাজিক নিপীড়ন চলেছে তা রাজলক্ষ্মী, কমললতা, অন্নদা প্রভৃতি চরিত্রগুলির মধ্যে তুলে ধরেছেন। বামুনের মেয়ে উপন্যাসে দেখাগেছে যে, নারীর কুল রক্ষার্থে ৮০-৯০ বছরের একজন কুলীন বামুনকে মৃত্যুর আগের দিন পর্যন্ত ৯-১১ বছরের বালিকার সাথে বিয়ের পিড়িতে বসতে হয়েছে। কুল রক্ষার তালিকা এত দীর্ঘ হয়েছে যে তা খাতায় লিখে রাখতে হয়েছে। অকাল বৈধব্য হলে সেই বালিকাকে হয় সতী হিসেবে পুড়িয়ে মারা হয়েছে নতুবা তার জীবন থেকে কেড়ে নেওয়া হয়েছে বেঁচে থাকার সমস্ত উপায়। একবেলা খাওয়া, এক কাপড় পরিধান করা, মাথার চুল কেটে ফেলা এবং সমস্ত সামজিক ক্রিয়াকর্ম থেকে তাকে বঞ্চিত করা ছিল ব্রাহ্মন্যবাদী নিদান। অন্যদিকে এই নিদানগুলি পালন না করতে না পারলে তার জায়গা হয়েছে পতিতালয়। নতুবা ধর্মের নামে নির্বাসিত হয়েছে কাশী, বৃন্দাবন বা মথুরা। জীবিকা হয়েছে ভিক্ষাবৃত্তি অথবা বেশ্যা বৃত্তি। সেন আমল থেকে একেবারে লর্ড বেন্টিং এর শাসনকাল পর্যন্ত এই জুলুম চলেছে নির্বিবাদে।
নারীর ক্ষমতায়নে মঙ্গল কাব্যের অবদানঃ
বাংলায় নারীদের ক্ষমতায়নের পরিকল্পনা রচিত হয় কবিদের কল্পনায়। সম্ভবত মায়েদের উপর এই দীর্ঘ নির্যাতন গ্লানি তাদের কোমল হৃদয়কে ব্যথিত করে তোলে। পুঞ্জিভূত যন্ত্রণা আবেগঘন করে তোলে কবি মন। বিভিন্ন কবি নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠায় অসির থেকে মসিকেই শক্তিশালী আয়ূধ হিসেবে বেছে নেয়। বাংলার পদাবলী সাহিত্য, অনুবাদ সাহিত্য ও মঙ্গলকাব্যগুলি নারী শক্তি জাগরণের অন্যতম অধ্যায়। পদাবলী সাহিত্যে নারী মনের আকুতি বর্ণিত হলেও তা পুরুষ মননে নারীর প্রতি প্রেম ভালবাসারই বহিঃপ্রকাশ। নারী এখানে ভোগের বস্তু থেকে প্রেমের নম্র সহচরী হিসেবে উঠে আসে।
কৃত্তিবাসের পণ্ডিতের অমৃত লহরীঃ
অকাল বোধন কৃত্তিবাসের কীর্তি। বাল্মীকি রামায়ণে রাম কোন দুর্গাকে পূজা করেননি। বা দুর্গা পূজা করার জন্য রাবণকে পুরোহিত হতে হয় নি। বরং রাবনের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জয় লাভ করার জন্য রাম সূর্যের পূজা করেছিলেন এবং সেই পূজায় পুরোহিত ছিলেন অগস্ত মুনি। Valmiki Ramayana - Yuddha Kanda in Prose Sarga 105। কৃত্তিবাস পণ্ডিত তবে মিথ্যে ঝুঁকি নিলেন কেন? তিনি তো জানতেন কালে তার এই শঠতা মিথ্যে বলে প্রতিপাদিত হবে। সম্ভবত কৃত্তিবাস জেনেবুঝেই এই ঝুঁকি নিয়ে ছিলেন কেননা মিথ্যের শাস্তির থেকে তিনি ব্রাহ্মন্যবাদী সমাজের ভবিষ্যৎ নির্মাণ করার উপর বেশি চিন্তিত ছিলেন। এ বিষয়ে ভাষাবিদ্ সুকুমার সেন তার ' ভারতীয় আর্য সাহিত্যে ইতিহাস ' পুস্তকে বিশেষ ভাবে যা আলোচনা করেছেন তার খানিকটা তুলে দিলামঃ
"বাংলায় প্রথম শারদীয় দূর্গাপূজা আরম্ভ হয় ১৫ শতকের শেষ ভাগে নদীয়া জেলার তাহেরপুরের জমিদার রাজা কংসনারায়ণ খান মহাশয়ের রাজবাটিতে ৷ নদীয়ার ফুলিয়ার কবি কৃত্তিবাস ওঝা সেই রাজা কংসনারায়ণ খানের সভাপন্ডিত ছিলেন ৷ নিজের প্রতি-পত্তি জাহির করবার জন্য রাজা কংসনারায়ণ প্রাচিন কালের দিগ্বিজয়ী সম্রাটদের মত " অশ্বমেধ " যজ্ঞ করিবার বাসনা করেন ৷ কিন্তু তাঁহার কুলপুরোহিত রমেশচন্দ্র শাস্ত্রী মহাশয় বলেন যে এই যুগে ' অশ্বমেধ ' যজ্ঞ সম্ভব নয় ৷ তবে সভা পন্ডিত কৃত্তিবাস ওঝা মহাশয়ের সহিত সলাপরামর্শ করিয়া পুরোহিত রমেশ শাস্ত্রী মহাশয় রাজাকে বুঝাইলেন যে কলিযুগে অকালবোধন ' শারদীয় দূর্গাপূজা ' করিলে অশ্বমেধ যজ্ঞের সমতুল্য রাজ-খ্যাতি প্রচারিত হইবে ৷ রাজা কংসনারায়ণ খান তাহাই করিয়াছিলে".........৷
এই পূজায় রাজা কংসনারায়ণ খান তৎকালীন ৮ লক্ষ টাকা ব্যয় করে বিপুল লোক লস্কর লাগিয়ে পূজা শুরু করলেন। কয়েক বছর ধরে এই পূজার অর্থ যোগান দিতে গিয়ে তিনি সর্বস্বান্ত হলেন। তার রাজ্য এবং রাজবংশ নিশ্চিহ্ন হল কিন্তু ঠিকে গেল কৃত্তিবাসী রামায়ন এবং তার "অকাল বোধন"। এখানে রচিত হল নতুন রাম কাহিনী। এই রাম্যানের রাম বসন্ত কালের পরিবর্তে যুদ্ধে জয় লাভ করার জন্য শরত কালে করলেন দুর্গা পূজা। আর সেই পূজায় নিজের মৃত্যু মহিমান্বিত করার জন্য রাবণ হলেন পুরোহিত! অর্থাৎ কৃত্তিবাস পুনরায় প্রতিষ্ঠা করলেন যে প্রজাপতি ব্রহ্মার বিস্তারের জন্য পুরুষকে বলি প্রদত্ত হতে হবে এবং ব্রাহ্মণের ইচ্ছা পূর্ণ করার জন্য শূদ্র নিজের মৃত্যুকে ডিভাইন মৃত্যু হিসেবে মেনে নেবে। আর একটি কথা এখানে একান্ত বলা প্রয়োজন যে বাংলার ব্রহ্মনেরা তখন বেশ বুঝতে পেরেছিলেন যে নারী শক্তি আত্মস্ত করার মধ্য দিয়েই ব্রাহ্মণের ভবিষ্যৎ টিকে থাকবে এবং এই কথা বুঝতে পেরেই নারীকে "দুর্গা রুপেন সংস্থিতায়"রূপদান করার জন্য রাজশক্তি ব্যবহার করে ঝাঁপিয়ে পড়লেন নব নির্মাণে। এই নির্মাণ প্রক্রিয়াকে সংবদ্ধতা দিলেন মঙ্গল কাব্যে। নিজেদের প্রয়োজনেই ব্রাহ্মনেরা মঙ্গলকাব্যে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার উপরে নারীদের দেবী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করলেন এবং এই নারী শক্তি ব্যবহার করেই প্রচলিত লোকাচার ও লোকসংস্কৃতিকে ধ্বংস অথবা তাকে পরিবর্তিত করে দেবায়নের মোড়কে বাজারজাত করলেন। বিদ্যাপতি কালীকা পুরাণের থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে এমন এক শবরোৎসবের উদাহরণ দিয়েছিলেনঃ 'কুমারী, বেশ্যা, নর্তকীদের নিয়ে শঙ্খ, তূর্য, মৃদঙ্গ, ঢোল বাজিয়ে বহুবিধ ধ্বজা বস্ত্র সহ খৈ, ফুল ছড়িয়ে, পরস্পরের প্রতি ধুলো কাঁদা ছিটিয়ে ক্রীড়া ও কৌতুক গান করতে করেতে যাত্রা করবে। ভগলিঙ্গ, যৌনউত্তেজক গান এবং তদৃশ্য বাক্যালাপ করে আনন্দ করবে, এই সময় যে ব্যক্তি অশ্লীলতা ভালোবাসেনা বা নিজেও অপরের বিরুদ্ধে এরূপ শব্দ ব্যবহার করেনা ভগবতী ক্রুদ্ধ হয়ে তাকে শাপ দেবেন এবং বিনাশ করবেন'।
বৃহদ্ধর্ম পুরাণেও এই শবরোৎসবের বর্ণনা আছেঃ
'ভগ লিঙ্গাভিধানৈশ্চ শৃঙ্গার বচনৈ স্তথা –
গানং কার্যং ভোজয়চ্চ ব্রাহ্মনাৎ স্তোষয়েস্ত্রিয়া'।
( বৃহদ্ধর্ম পুরাণ ২২ অধ্যায় ২০-৩০পৃ )
পৌরাণিক আখ্যান কাব্যের উপর রচিত অন্নদামঙ্গল ও শাক্ত পদাবলীতে কবিরা সযত্নে দেবদেবীদের স্বর্গের মহিমা পরিত্যাগ করে বাংলার নরনারীতে পরিণত কারেছেন যাতে দেবায়ন লোকায়ত হয় এবং দেবসমাজ আরো বেশী গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠে। অর্থাৎ কার্যত পূজার ছলে নারীকে আবার বাজারী পণ্যদ্রব্যে পরিণত করে খোলাহাটে পশরা সাজিয়ে বসলেন ব্রাহ্মণ সমাজ। এতে বৈষ্ণবীয় প্রেমের মাধুর্য নিস্প্রভ হল বটে ভোগের বজার বন্ধ হলনা। বন্ধ হল না পতিতাবৃত্তি,বাল্য বিবাহ, বহু বিবাহ, গুরুকরণী এবং সতী প্রথা। বরং ব্রাহ্মণ্যবাদীদের ভোগের বাজারে আর একটি নতুন গণসম্মোহনী পণ্য যুক্ত হল।
সতীদাহ বা সহমরণপ্রথা এবং বিধবা বিবাহঃ
সম্ভবত মানব সমাজের বিবর্তনের ইতিহাসে নারীর উপর পুরুষতান্ত্রিক বর্বরতার সবথেকে নিষ্ঠুর প্রথা সতীদাহ বা সহমরণ। যেখানে পরলোকের লোভ দেখিয়ে নারীকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হত। কিশোরী, গর্ভবতী বা শিশু সন্তানের জননী হলেও তাকে রেহাই দেওয়া হতনা। বরং এই মৃত্যুকে স্বর্গীয় মহিমাতে রূপদান করার সার্বিক প্রচেষ্টায় নিয়োজিত ছিল ব্রাহ্মণসমাজ। ব্রাহ্মণ সমাজপতিরা একে সর্বশ্রেষ্ঠ পুণ্যকাজ বলে পরচার করতেন। ১৮১৩ সালের "লর্ড মিন্টোর সংস্কার আইন"অনিচ্ছুক নারীকে পুড়িয়ে মারা যাবেনা বলে ঘোষণা করে। ১৮১৭ সালে সতীদাহকে নরহত্যার পর্যায়ভুক্ত করে শাস্তির নির্দেশ দেওয়া হয়। সতীদাহ নিষিদ্ধ করার আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন রামমোহন রায় ও দ্বারকানাথ ঠাকুর। ১৮২৮ সালের ৪ঠা ডিসেম্বর লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক আইন করে সতীদাহ বন্ধ করে দেন। সতীদাহ বন্ধ হলে ভূদেবতাদের সব রাগ গিয়ে পড়ে বিধবাদের উপর। তারা দুর্বিষহ সামাজিক ও ধর্মীয় শৃঙ্খলে বেঁধে ফেলতে চাইল বিধবাদের। নিরম্বু উপবাস, একাদশী পালন, দিনে একবার খাওয়া, একবস্ত্র পরিধান, তেল না মাখা, নিরামিষ ভোজন এমন নানাবিধ অনুশাসনের নাগপাশে রুদ্ধ হল তাদের জীবন। অন্যদিকে গোপনে ভুদেবতাদের জৈবিক কামনার শিকার হতে লাগল বিধবা যুবতীরা। এই সব যুবতী মহিলাদের পুনর্বিবাহের কোন সুযোগ ছিলনা। ফেলে সমাজের অভ্যন্তরে দিনে দিনে বাড়তে লাগল অনাচারের আবর্জনা। কিন্তু লাম্পট ও চরিত্রহীনদের কদাচারের ফল ভোগ করতে হল নারীকে। বহু নারী পতিতাবৃত্তিতা বেছে নিল। ধর্মান্তরিত হল অনেকে। আবার অনেকে কাশী, বৃন্দাবনে আশ্রয় নিয়ে ভিখারির জীবন অথবা পতিতার জীবন গ্রহণ করতে বাধ্য হল।
বিদ্যাসাগর বিধবাদের উপর প্রভূসমাজের এই নির্যাতন বন্ধ করার জন্য তার পাণ্ডিত্য, বাগ্মিতা ও বিতর্ককে অস্ত্র করলেন। বামুন সমাজের প্রবল বাঁধা পেরিয়ে ১৮৬৫ সালে বিধবা বিবাহ আইনসিদ্ধ হল। এখানে বলে রাখা ভাল যে সতীদাহ বা বিধবা বিবাহের সমস্যা কৌম সমাজ বা অসুর সমাজে একেবারেই ছিলনা। তাদের সামাজিক আন্তর্গঠনের মধ্যে নিহিত ছিল নারীর সমানাধিকারের সম্মান।
অসুর নয়, বামুনই কদাচারের আসল মুখঃ
মানবেতিহাসে অশুভ শক্তির বিনাশ ও শুভ শক্তির বিকাশ হল দুর্গা পূজার অন্যতম অভিধা। কিন্তু এই ধাঁধার উত্তর খোঁজা জরুরী যে বাংলার ইতিহাসে কারা এই অশুভ শক্তির প্রতীক! কাদের দুর্দম্য, দুর্বিনীত আচরণের জন্য বাংলা কলুষিত হয়েছে বার বার? কারাই বা নারীকে ক্লেদাক্ত পঙ্কে নিক্ষিপ্ত করেছে। কারা নিমজ্জিত হয়েছে লুন্ঠন, ধর্ষণ ও জিঘাংসায়? কারা পূজার অছিলায় দুর্গা শক্তির নামে সমগ্র নারীসমাজকে গণিকার পর্যায়ে নামিয়ে দিয়েছে? কারা এখনো পর্যন্ত নারীকে নরকের দ্বার মনে করে? কারাই বা শুধুমাত্র পুত্র কামনার্থে নারীকে ভোরগের সামগ্রী মনে করে? কারাইবা নারীকে বহুগামিতা ও বহুবিবাহে প্রলুব্ধ করে? এই সমস্ত কাজ যদি সমাজ বিকাশে অকল্যাণকারী হয় এবং এদেরকেই যদি অশুভ শক্তির ধারক বাহক হিসেবে চিহ্নিত করতে হয়; তবে নিশ্চিত ভবেই ভারতের ব্রাহ্মণ সমাজ এই অশুভ শক্তি হিসেবে চিহ্নিত হবে। সেই অশুভ শক্তিকে বিনাশ করার জন্য অসুর মূরতির পরিবর্তে টিকি এবং পৈতেধারী ভুঁড়িওয়ালা বামুনের মূর্তি বসানো হোক। লোভ, লালসা, কামনা, বাসনা, জিঘাংসা ও কদাচারের বীভৎস মুখোশ খুলে যাক। কদাচারীদের মুখ মানুষের সামনে প্রকাশিত হোক যাতে কল্যাণকারী সমাজ পুনর্গঠনে মানুষ আরো সচেতন প্রয়াস গ্রহণ করতে পারে।
ভারতীয় ইতিহাসে অসুরভাষী রাজাদের শাসনে নারীকে সমান ভাবে মর্যাদা দোওয়া হয়েছে তার ইতিহাস নান সূত্র থেকে আমরা পাই। মূলতঃ মাতৃতান্ত্রিক সমাজের মাধুর্যতায় গড়ে উঠেছিল ভারতের কৌম সমাজের ভিত। আর অসুর রাজারা তাকে মান্যতা দিয়ে গড়ে তুলেছিল বিভিন্ন জনপদ। সাওতাল সমাজের জোম–সিম-বিন্তির মধ্যে মানব সমাজের বিবর্তনে পিলচু হড়াম ও পিলচু বা বুড়িকে সমান গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে, বরং নারীর ইচ্ছাকেই সৃষ্টির প্রেরণা হিসেবে দেখানো হয়েছে এই সব বিন্তিগুলিতে। হরপ্পার (আদি অস্ট্রিক শব্দ, যা হড় ও হপ্পন দুটি শব্দের সমাহার) খননকার্যে যে প্রত্ন নিদর্শনগুলি উঠে এসেছে তাতে নিশ্চিত ভাবে প্রমাণিত হয় যে সেকালে নারীকে পুরুষের সাথে সমান গুরুত্ব দেওয়া হত। হরপ্পায় মাতৃ মূর্তিগুলি শৈল্পিক ভাবনায় অনন্য। মহামতি গোতমা বুদ্ধের সময় ভিক্ষুনী সংঘ গড়ে ওঠে। মাতা গোতমীর নেতৃত্বে ৫০০ শতাধিক নারী প্রবজ্জা গ্রহণ করেন। প্রতিষ্ঠিত হয় ভিক্ষুনী সংঘ। ভিক্ষুদের মতই ভিক্ষুনীরা সমান মর্যাদায় ধম্ম প্রচারের সর্বোচ্চ সম্মান পান। নারী পুরুষের সমমর্যাদা ও সমানধিকার প্রতিষ্ঠার এটাই সর্বপ্রথম নিদর্শন। এই নারীদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় লেখা "থেরীগাঁথা"যা বুদ্ধ সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ সম্পদ। বুদ্ধের অন্যতম অনুগামী "তারা"তার জীবিত কালেই বুদ্ধের সমান খ্যাতি অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। কালচক্রযানী, প্রজ্ঞা ও পারমিতার সুষম অভিধায় ভূষিতা 'তারা'তিব্বত, চীন, জাপান ও দক্ষিণপূর্ব দীপ রাষ্ট্রগুলিতে বুদ্ধের মতই আদরণীয়া। নারীর সৃজনে ও মননে আপন মহিমায় বিকশিত হওয়ার অনন্য প্রতীক এই 'তারা'।
বৈদিক যুগে নারীর অধিকারঃ
বৈদিক সমাজের প্রথম দিকেও নারীর বিভিন্ন সামাজিক অধিক স্বীকার করা হয়েছিল। ঘোষা, লোপামূদ্রা, মৈত্রেই ও গার্গীর মত মহীয়সী নারীরা বেদের শ্লোক রচনার কাজেও অবদান রাখতে পেরেছিলেন। সামাজিক নানা কাজে নারীদের স্বতন্ত্র ভুমিকা মেনে নিয়েছিল বৈদিক সমাজ। নিজের ইচ্ছায় তারা পুরুষ সঙ্গী নির্বাচন করতে পারত, এমনকি বিধবাদের পুনর্বিবাহের স্বীকৃতিও ছিল। "Women enjoyed far greater freedom in the Vedic period than in later India. She had more to say in the choice of her mate than the forms of marriage might suggest. She appeared freely at feasts and dances, and joined with men in religious sacrifice. She could study, and like Gargi, engage in philosophical disputation. If she was left a widow there was no restrictions upon her remarriage." Will Durant - Story of Civilization: Our Oriental Heritage.
তবে পরবর্তী কালে নারীর সমস্ত অধিকার কেড়ে নেওয়া হল কেন? বিশেষত মনুর কাল থেকে নারীকে কেন পশু ও শূদ্রের পর্যায়ে নামিয়ে দেওয়া হল? "একজন বালিকা বা যুবতী বা বৃদ্ধা গৃহে স্বাধীন ভাবে কিছু করবেনা। স্ত্রীলোক বাল্যে পিতার বশ্য থাকবে, যৌবনে স্বামীর অধীনে, স্বামী প্রেতলোক প্রাপ্ত হলে পুত্রের অধীনে থাকবে। কোন পরিস্থিতিতে নারী স্বাধীন থাকবে না'।
(মনুস্মৃতি, ৫/১৪৭-১৫০)
অথবা "mam hi partha vyapasrit ya
ye 'pi syuh papa-yonayah
striyo vaisyas tatha sudras
te 'pi yanti param gatim"…… Bhagvat Gita, Chapter Nine text 32
"নারী, বৈশ্য এবং শূদ্রগণ পাপ যোনিতে জন্ম"।
ব্রাহ্মণ্য সাহিত্যের পরতে পরতে নারীর প্রতি এই বিদ্বেষ জন্মেছিল কোন কারণে? এই বিদ্বেষ কি ব্রাহ্মন্যবাদের স্বাভাবিক নিয়ম? নাকি শিকারজীবি যাযাবরদের ভোগ্য বস্তু সংগ্রহের মত নারীও ছিল তাদের ভোগের বস্তু? ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে কিন্তু এটাই প্রমান হিসেবে উঠে আসছে যে অসুর রাজাদের সম্পদ লুন্ঠনের সাথে সাথে তাদের নারীদের লুণ্ঠনও ছিল বর্বর আর্যদের অন্যতম লালসা। নারীদের বন্দী করা। তাদের সেনা শিবিরে বা দুর্গে নিয়ে গিয়ে যার যেমন খুশি যৌন ক্ষুধা মেটানোর লালসা। মূলত আর্য সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে সব থেকে বেশি নির্যাতনের শিকার হয়েছে নারী।
বেদের দশম মণ্ডলের পর বতুর্বর্ণ ব্যবস্থা সুদৃঢ় হলে ক্ষমতার বলেই বর্ণশ্রেষ্ঠ ব্রহ্মনেরা সব থেকে বেশী লাভবান হয়। এই সময় থেকেই শুরু হয় দেবায়নের প্রক্রিয়া। দেবশক্তি হিসেবে ব্রাহ্মনেরাই ক্ষমতার শীর্ষে অধিষ্ঠিত হয়। আর্য বা বৈদিক সমাজের বল্গাহীন শারীরিক সুখ ভোগের আকাঙ্ক্ষা তাদের ধর্ম অর্থ কাম ও মোক্ষের সাথে এমন ভাবে একাকার হয়ে যায় একে সার্বিক বৈধতা দিতে হয়। ধর্মের নামে, রীতিনীতির নামে, লোকাচারের নামে ব্যাভিচার হয়ে ওঠে সর্বত্রগামী। নারী পুরুষ নির্বিশেষে জৈবিক সুখ ভোগের প্লাবনে সমাজকে ভাসিয়ে দিতে চায় ব্রাহ্মণ্য দর্শন। এই দুর্দম্য লালসাকে সুরক্ষা ও বৈধতা দেওয়ার জন্য বৈদিক কাল থেকেই চলে নিরন্তর প্রয়াস। বেদ, ব্রাহ্মণ, পুরাণ, উপনিষদ এমনকি রামায়ণ ও মহাভারত কাব্যকে ব্যবহার করে চলে ব্যাপক প্রচার। ভোগবাদ ও যৌনাচারের এই প্রচার ও প্রসার এমন পর্যায়ে চলে যায় যে যৌন সঙ্গী নির্বাচনের ক্ষেত্রে মা, মেয়ে, ভাই, বোন প্রভৃতি বাঁধ বিচারের বাঁধন ধ্বংস হয়ে যায়। শতপথ ব্রাহ্মণ ও সরস্বতী পুরানে ব্রাহ্মাকে তার নিজের কন্যা সরস্বতীর সাথে যৌনাচারে লিপ্ত হতে দেখা যায় এবং এই যৌন মিলনে যে সন্তানের জন্ম হয় তার নাম স্বয়ম্ভূ মনু। মনু আবার তার মা সরস্বতীকে সম্ভোগ করে এবং তাদের একাধিক সন্তানের জন্ম হয়। নারী পুরুষ নির্বিশেষে এই বহুগামিতা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে সত্যাকাম গুরু গৌতমের কাছে তার নিজের পিতার নাম বা গোত্র বলতে পারেনি। সত্য কামের মা জবালাও বলতে পারেনি কোন পুরুষ সত্যকামের আসল পিতা। দেবারত পুত্র শিশু যাজ্ঞবল্ককে কোলের থেকে নামিয়ে তার মা অন্য ঋষির সাথে সহবাস করতে বাধ্য হয়েছিল এমন কাহিনী আমরা যাজ্ঞবল্ক স্মৃতিতেই দেখতে পাই। অর্থাৎ দেবতার নামে, ঈশ্বরের নামে সামাজিক রীতিনীতির নামে নারীকেই নিষ্পেষণের সহজ ক্ষেত্র হিসেবে চিহ্নিত করেছিল ব্রাহ্মন্যবাদ।
উত্তরকালে নারীদের উপর এই আধিপত্যবাদের চরম পরিণতি হিসেবে শুরু হয় পতিতাবৃত্তি, বাল্য বিবাহ, বহুবিবাহ, দেবদাসী ও সতী প্রথা। এবং এই সমস্ত কাদাচারই একটি বৃত্তকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়েছে। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের বহুবিবাহ এবং সম্বন্ধ নির্ণয় গ্রন্থে কুল রক্ষার নামে একজন কুলিন ব্রাহ্মণ যে একাধিক বিবাহ করতেন তার তালিকা তুলে ধরেছেন। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তার বিভিন্ন উপন্যাসে নারীদের উপর যে কী নিষ্ঠুর সামাজিক নিপীড়ন চলেছে তা রাজলক্ষ্মী, কমললতা, অন্নদা প্রভৃতি চরিত্রগুলির মধ্যে তুলে ধরেছেন। বামুনের মেয়ে উপন্যাসে দেখাগেছে যে, নারীর কুল রক্ষার্থে ৮০-৯০ বছরের একজন কুলীন বামুনকে মৃত্যুর আগের দিন পর্যন্ত ৯-১১ বছরের বালিকার সাথে বিয়ের পিড়িতে বসতে হয়েছে। কুল রক্ষার তালিকা এত দীর্ঘ হয়েছে যে তা খাতায় লিখে রাখতে হয়েছে। অকাল বৈধব্য হলে সেই বালিকাকে হয় সতী হিসেবে পুড়িয়ে মারা হয়েছে নতুবা তার জীবন থেকে কেড়ে নেওয়া হয়েছে বেঁচে থাকার সমস্ত উপায়। একবেলা খাওয়া, এক কাপড় পরিধান করা, মাথার চুল কেটে ফেলা এবং সমস্ত সামজিক ক্রিয়াকর্ম থেকে তাকে বঞ্চিত করা ছিল ব্রাহ্মন্যবাদী নিদান। অন্যদিকে এই নিদানগুলি পালন না করতে না পারলে তার জায়গা হয়েছে পতিতালয়। নতুবা ধর্মের নামে নির্বাসিত হয়েছে কাশী, বৃন্দাবন বা মথুরা। জীবিকা হয়েছে ভিক্ষাবৃত্তি অথবা বেশ্যা বৃত্তি। সেন আমল থেকে একেবারে লর্ড বেন্টিং এর শাসনকাল পর্যন্ত এই জুলুম চলেছে নির্বিবাদে।
নারীর ক্ষমতায়নে মঙ্গল কাব্যের অবদানঃ
বাংলায় নারীদের ক্ষমতায়নের পরিকল্পনা রচিত হয় কবিদের কল্পনায়। সম্ভবত মায়েদের উপর এই দীর্ঘ নির্যাতন গ্লানি তাদের কোমল হৃদয়কে ব্যথিত করে তোলে। পুঞ্জিভূত যন্ত্রণা আবেগঘন করে তোলে কবি মন। বিভিন্ন কবি নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠায় অসির থেকে মসিকেই শক্তিশালী আয়ূধ হিসেবে বেছে নেয়। বাংলার পদাবলী সাহিত্য, অনুবাদ সাহিত্য ও মঙ্গলকাব্যগুলি নারী শক্তি জাগরণের অন্যতম অধ্যায়। পদাবলী সাহিত্যে নারী মনের আকুতি বর্ণিত হলেও তা পুরুষ মননে নারীর প্রতি প্রেম ভালবাসারই বহিঃপ্রকাশ। নারী এখানে ভোগের বস্তু থেকে প্রেমের নম্র সহচরী হিসেবে উঠে আসে।
কৃত্তিবাসের পণ্ডিতের অমৃত লহরীঃ
অকাল বোধন কৃত্তিবাসের কীর্তি। বাল্মীকি রামায়ণে রাম কোন দুর্গাকে পূজা করেননি। বা দুর্গা পূজা করার জন্য রাবণকে পুরোহিত হতে হয় নি। বরং রাবনের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জয় লাভ করার জন্য রাম সূর্যের পূজা করেছিলেন এবং সেই পূজায় পুরোহিত ছিলেন অগস্ত মুনি। Valmiki Ramayana - Yuddha Kanda in Prose Sarga 105। কৃত্তিবাস পণ্ডিত তবে মিথ্যে ঝুঁকি নিলেন কেন? তিনি তো জানতেন কালে তার এই শঠতা মিথ্যে বলে প্রতিপাদিত হবে। সম্ভবত কৃত্তিবাস জেনেবুঝেই এই ঝুঁকি নিয়ে ছিলেন কেননা মিথ্যের শাস্তির থেকে তিনি ব্রাহ্মন্যবাদী সমাজের ভবিষ্যৎ নির্মাণ করার উপর বেশি চিন্তিত ছিলেন। এ বিষয়ে ভাষাবিদ্ সুকুমার সেন তার ' ভারতীয় আর্য সাহিত্যে ইতিহাস ' পুস্তকে বিশেষ ভাবে যা আলোচনা করেছেন তার খানিকটা তুলে দিলামঃ
"বাংলায় প্রথম শারদীয় দূর্গাপূজা আরম্ভ হয় ১৫ শতকের শেষ ভাগে নদীয়া জেলার তাহেরপুরের জমিদার রাজা কংসনারায়ণ খান মহাশয়ের রাজবাটিতে ৷ নদীয়ার ফুলিয়ার কবি কৃত্তিবাস ওঝা সেই রাজা কংসনারায়ণ খানের সভাপন্ডিত ছিলেন ৷ নিজের প্রতি-পত্তি জাহির করবার জন্য রাজা কংসনারায়ণ প্রাচিন কালের দিগ্বিজয়ী সম্রাটদের মত " অশ্বমেধ " যজ্ঞ করিবার বাসনা করেন ৷ কিন্তু তাঁহার কুলপুরোহিত রমেশচন্দ্র শাস্ত্রী মহাশয় বলেন যে এই যুগে ' অশ্বমেধ ' যজ্ঞ সম্ভব নয় ৷ তবে সভা পন্ডিত কৃত্তিবাস ওঝা মহাশয়ের সহিত সলাপরামর্শ করিয়া পুরোহিত রমেশ শাস্ত্রী মহাশয় রাজাকে বুঝাইলেন যে কলিযুগে অকালবোধন ' শারদীয় দূর্গাপূজা ' করিলে অশ্বমেধ যজ্ঞের সমতুল্য রাজ-খ্যাতি প্রচারিত হইবে ৷ রাজা কংসনারায়ণ খান তাহাই করিয়াছিলে".........৷
এই পূজায় রাজা কংসনারায়ণ খান তৎকালীন ৮ লক্ষ টাকা ব্যয় করে বিপুল লোক লস্কর লাগিয়ে পূজা শুরু করলেন। কয়েক বছর ধরে এই পূজার অর্থ যোগান দিতে গিয়ে তিনি সর্বস্বান্ত হলেন। তার রাজ্য এবং রাজবংশ নিশ্চিহ্ন হল কিন্তু ঠিকে গেল কৃত্তিবাসী রামায়ন এবং তার "অকাল বোধন"। এখানে রচিত হল নতুন রাম কাহিনী। এই রাম্যানের রাম বসন্ত কালের পরিবর্তে যুদ্ধে জয় লাভ করার জন্য শরত কালে করলেন দুর্গা পূজা। আর সেই পূজায় নিজের মৃত্যু মহিমান্বিত করার জন্য রাবণ হলেন পুরোহিত! অর্থাৎ কৃত্তিবাস পুনরায় প্রতিষ্ঠা করলেন যে প্রজাপতি ব্রহ্মার বিস্তারের জন্য পুরুষকে বলি প্রদত্ত হতে হবে এবং ব্রাহ্মণের ইচ্ছা পূর্ণ করার জন্য শূদ্র নিজের মৃত্যুকে ডিভাইন মৃত্যু হিসেবে মেনে নেবে। আর একটি কথা এখানে একান্ত বলা প্রয়োজন যে বাংলার ব্রহ্মনেরা তখন বেশ বুঝতে পেরেছিলেন যে নারী শক্তি আত্মস্ত করার মধ্য দিয়েই ব্রাহ্মণের ভবিষ্যৎ টিকে থাকবে এবং এই কথা বুঝতে পেরেই নারীকে "দুর্গা রুপেন সংস্থিতায়"রূপদান করার জন্য রাজশক্তি ব্যবহার করে ঝাঁপিয়ে পড়লেন নব নির্মাণে। এই নির্মাণ প্রক্রিয়াকে সংবদ্ধতা দিলেন মঙ্গল কাব্যে। নিজেদের প্রয়োজনেই ব্রাহ্মনেরা মঙ্গলকাব্যে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার উপরে নারীদের দেবী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করলেন এবং এই নারী শক্তি ব্যবহার করেই প্রচলিত লোকাচার ও লোকসংস্কৃতিকে ধ্বংস অথবা তাকে পরিবর্তিত করে দেবায়নের মোড়কে বাজারজাত করলেন। বিদ্যাপতি কালীকা পুরাণের থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে এমন এক শবরোৎসবের উদাহরণ দিয়েছিলেনঃ 'কুমারী, বেশ্যা, নর্তকীদের নিয়ে শঙ্খ, তূর্য, মৃদঙ্গ, ঢোল বাজিয়ে বহুবিধ ধ্বজা বস্ত্র সহ খৈ, ফুল ছড়িয়ে, পরস্পরের প্রতি ধুলো কাঁদা ছিটিয়ে ক্রীড়া ও কৌতুক গান করতে করেতে যাত্রা করবে। ভগলিঙ্গ, যৌনউত্তেজক গান এবং তদৃশ্য বাক্যালাপ করে আনন্দ করবে, এই সময় যে ব্যক্তি অশ্লীলতা ভালোবাসেনা বা নিজেও অপরের বিরুদ্ধে এরূপ শব্দ ব্যবহার করেনা ভগবতী ক্রুদ্ধ হয়ে তাকে শাপ দেবেন এবং বিনাশ করবেন'।
বৃহদ্ধর্ম পুরাণেও এই শবরোৎসবের বর্ণনা আছেঃ
'ভগ লিঙ্গাভিধানৈশ্চ শৃঙ্গার বচনৈ স্তথা –
গানং কার্যং ভোজয়চ্চ ব্রাহ্মনাৎ স্তোষয়েস্ত্রিয়া'।
( বৃহদ্ধর্ম পুরাণ ২২ অধ্যায় ২০-৩০পৃ )
পৌরাণিক আখ্যান কাব্যের উপর রচিত অন্নদামঙ্গল ও শাক্ত পদাবলীতে কবিরা সযত্নে দেবদেবীদের স্বর্গের মহিমা পরিত্যাগ করে বাংলার নরনারীতে পরিণত কারেছেন যাতে দেবায়ন লোকায়ত হয় এবং দেবসমাজ আরো বেশী গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠে। অর্থাৎ কার্যত পূজার ছলে নারীকে আবার বাজারী পণ্যদ্রব্যে পরিণত করে খোলাহাটে পশরা সাজিয়ে বসলেন ব্রাহ্মণ সমাজ। এতে বৈষ্ণবীয় প্রেমের মাধুর্য নিস্প্রভ হল বটে ভোগের বজার বন্ধ হলনা। বন্ধ হল না পতিতাবৃত্তি,বাল্য বিবাহ, বহু বিবাহ, গুরুকরণী এবং সতী প্রথা। বরং ব্রাহ্মণ্যবাদীদের ভোগের বাজারে আর একটি নতুন গণসম্মোহনী পণ্য যুক্ত হল।
সতীদাহ বা সহমরণপ্রথা এবং বিধবা বিবাহঃ
সম্ভবত মানব সমাজের বিবর্তনের ইতিহাসে নারীর উপর পুরুষতান্ত্রিক বর্বরতার সবথেকে নিষ্ঠুর প্রথা সতীদাহ বা সহমরণ। যেখানে পরলোকের লোভ দেখিয়ে নারীকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হত। কিশোরী, গর্ভবতী বা শিশু সন্তানের জননী হলেও তাকে রেহাই দেওয়া হতনা। বরং এই মৃত্যুকে স্বর্গীয় মহিমাতে রূপদান করার সার্বিক প্রচেষ্টায় নিয়োজিত ছিল ব্রাহ্মণসমাজ। ব্রাহ্মণ সমাজপতিরা একে সর্বশ্রেষ্ঠ পুণ্যকাজ বলে পরচার করতেন। ১৮১৩ সালের "লর্ড মিন্টোর সংস্কার আইন"অনিচ্ছুক নারীকে পুড়িয়ে মারা যাবেনা বলে ঘোষণা করে। ১৮১৭ সালে সতীদাহকে নরহত্যার পর্যায়ভুক্ত করে শাস্তির নির্দেশ দেওয়া হয়। সতীদাহ নিষিদ্ধ করার আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন রামমোহন রায় ও দ্বারকানাথ ঠাকুর। ১৮২৮ সালের ৪ঠা ডিসেম্বর লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক আইন করে সতীদাহ বন্ধ করে দেন। সতীদাহ বন্ধ হলে ভূদেবতাদের সব রাগ গিয়ে পড়ে বিধবাদের উপর। তারা দুর্বিষহ সামাজিক ও ধর্মীয় শৃঙ্খলে বেঁধে ফেলতে চাইল বিধবাদের। নিরম্বু উপবাস, একাদশী পালন, দিনে একবার খাওয়া, একবস্ত্র পরিধান, তেল না মাখা, নিরামিষ ভোজন এমন নানাবিধ অনুশাসনের নাগপাশে রুদ্ধ হল তাদের জীবন। অন্যদিকে গোপনে ভুদেবতাদের জৈবিক কামনার শিকার হতে লাগল বিধবা যুবতীরা। এই সব যুবতী মহিলাদের পুনর্বিবাহের কোন সুযোগ ছিলনা। ফেলে সমাজের অভ্যন্তরে দিনে দিনে বাড়তে লাগল অনাচারের আবর্জনা। কিন্তু লাম্পট ও চরিত্রহীনদের কদাচারের ফল ভোগ করতে হল নারীকে। বহু নারী পতিতাবৃত্তিতা বেছে নিল। ধর্মান্তরিত হল অনেকে। আবার অনেকে কাশী, বৃন্দাবনে আশ্রয় নিয়ে ভিখারির জীবন অথবা পতিতার জীবন গ্রহণ করতে বাধ্য হল।
বিদ্যাসাগর বিধবাদের উপর প্রভূসমাজের এই নির্যাতন বন্ধ করার জন্য তার পাণ্ডিত্য, বাগ্মিতা ও বিতর্ককে অস্ত্র করলেন। বামুন সমাজের প্রবল বাঁধা পেরিয়ে ১৮৬৫ সালে বিধবা বিবাহ আইনসিদ্ধ হল। এখানে বলে রাখা ভাল যে সতীদাহ বা বিধবা বিবাহের সমস্যা কৌম সমাজ বা অসুর সমাজে একেবারেই ছিলনা। তাদের সামাজিক আন্তর্গঠনের মধ্যে নিহিত ছিল নারীর সমানাধিকারের সম্মান।
অসুর নয়, বামুনই কদাচারের আসল মুখঃ
মানবেতিহাসে অশুভ শক্তির বিনাশ ও শুভ শক্তির বিকাশ হল দুর্গা পূজার অন্যতম অভিধা। কিন্তু এই ধাঁধার উত্তর খোঁজা জরুরী যে বাংলার ইতিহাসে কারা এই অশুভ শক্তির প্রতীক! কাদের দুর্দম্য, দুর্বিনীত আচরণের জন্য বাংলা কলুষিত হয়েছে বার বার? কারাই বা নারীকে ক্লেদাক্ত পঙ্কে নিক্ষিপ্ত করেছে। কারা নিমজ্জিত হয়েছে লুন্ঠন, ধর্ষণ ও জিঘাংসায়? কারা পূজার অছিলায় দুর্গা শক্তির নামে সমগ্র নারীসমাজকে গণিকার পর্যায়ে নামিয়ে দিয়েছে? কারা এখনো পর্যন্ত নারীকে নরকের দ্বার মনে করে? কারাই বা শুধুমাত্র পুত্র কামনার্থে নারীকে ভোরগের সামগ্রী মনে করে? কারাইবা নারীকে বহুগামিতা ও বহুবিবাহে প্রলুব্ধ করে? এই সমস্ত কাজ যদি সমাজ বিকাশে অকল্যাণকারী হয় এবং এদেরকেই যদি অশুভ শক্তির ধারক বাহক হিসেবে চিহ্নিত করতে হয়; তবে নিশ্চিত ভবেই ভারতের ব্রাহ্মণ সমাজ এই অশুভ শক্তি হিসেবে চিহ্নিত হবে। সেই অশুভ শক্তিকে বিনাশ করার জন্য অসুর মূরতির পরিবর্তে টিকি এবং পৈতেধারী ভুঁড়িওয়ালা বামুনের মূর্তি বসানো হোক। লোভ, লালসা, কামনা, বাসনা, জিঘাংসা ও কদাচারের বীভৎস মুখোশ খুলে যাক। কদাচারীদের মুখ মানুষের সামনে প্রকাশিত হোক যাতে কল্যাণকারী সমাজ পুনর্গঠনে মানুষ আরো সচেতন প্রয়াস গ্রহণ করতে পারে।