ওপার বাংলার ফুফুর চিঠি এপার বাংলার চিত্রকর সুমিত গুহকে
পলাশ বিশ্বাস
তেমন প্রাণ যদি হয় কারো,যদি সেই প্রাণে থাকে ভালোবাসা টান টান,ত সীমান্তের কাঁটাতার বাংলা ভাগ করতে পারে না.
দেশভাগের বলি হয়ে আজীবন শরণার্থী জীবন ও জীবিকার টানাপোড়েনে ঔ কাঁটাতারের বেড়াকেই চোখে চোখে রেখেছি.যেহেতু আমার মৃত বাবা কোনোদিন ঔ সীমান্তরেখা মেনে নিতে পারেন নি.
বাবা তাই নদিয়ার জনসভায় যোগেন মন্ডলের সঙ্গে তর্কাতর্কি করে রাগে সীমান্ত পেরিয়ে ওপার বাংলার ভাষা আন্দোলনের মিছিলে অংশ নিয়ে জেলে যেতে পারতেন.
তুষারকান্তি ঘোষের মত বন্ধুও ছিল যার,যিনি তাঁকে জেল থেকে ছাড়িয়েও আনতে পারতেন.
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ঔ সীমান্ত উড়িয়ে দেওয়ার দাবিও তুলেছিলেন আমার বাবা সারা ভারতে উলুখাগড়াম শবের মত ছড়িয়ে থাকা উদ্বাস্তুদের পুলিনবাবু.জেলেও ছিলেন.ভারতের চর অভিযোগে.
যিনি আবার পশ্চিম বঙ্গের প্রতি কোনো টান কোনোদিন নিজের প্রাণে বোধ করেছেন কিনা,আমার জানা ছিল না.
দন্ডকারণ্যের উদ্বাস্তুদের মরিচঝাঁপির বলি হতে তিনি নিষেধ করেছিলেন.তাঁরা শোনেননি.বাংলার বুকে তাঁদের নিধনযজ্ঞ এখন ইতিহাস.
বাবা কিন্তু উত্তর ও পূর্বোত্তর ভারতের উদ্বাস্তুদের বোঝাতে পেরেছিলেন যে বাংলার ইতিহাস ও ভাগোলে আমরা চিরতরে বহিরাগত.
বাবা সীমান্ত পেরোতে পাখিদের মতই স্বাধীন ছিলেন.
সোদপুরে বউমাকে চা তৈরি করতে অবলীলায় তিনি ঢাকা,ফরিদপুর খুলনা বরিশাল ঘুরে এসে বলতে পারতেন,দেখে এলাম আমাদের সেই হারানো দ্যাশ.
ঔ দ্যাশের টান হিন্দু রাষ্ট্রে হিন্দু হয়ে জন্মানোর পরও রক্তে এখনো ভেসে বেড়ায়.
বাবা পাসপোর্ট করাননি.
বাবা ভিসার ধার ধারেননি.
কিন্তু যখনই সেই টান চেনেছিল তাঁকে,ছুটে চলে গিয়েছেন দ্যাশে অবলীলায় সীমান্তের কাঁটাতার ডিঙ্গিয়ে.
অথচ আমার একবারও বাংলাদ্যাশ দেখা হল না.
অথচ আমারা একবারও দ্যাশ দেখা হল না.
ভারতবর্ষ বাবা পায়ে পায়ে ঘুরেছেন.
আমি উড়ে উড়ে ভারতবর্ষ দেখেছি.
হয়ত বাবার চাইতে বেশি দেখেছি.
হয়ত সীমান্তের বাঁধন ছিড়ে দেশে দেশে বন্ধুও আমার অনেক বেশি.কিন্তু পাসপোর্ট ছাড়া,ভিসা ছাড়া সীমান্ত পেরিয়ে পাখি হওয়ার ডানা আমার কখনো হল না.
বা সত্যি বলতে, শিকড়ের সেই টান নেই,যা মুড়ো ধরে টেনে নেবে ভালোবাসার বুকে আমাকে.
ঔ বাবার ছেলে হয়ে সীমান্ত পার হওযার জন্য পাসপোর্ট বা ভিসার অনুসন্ধান করিনি কখনো.
যদি সীমান্ত ডিঙ্গিয়ে যাওয়ার মন্ত্র কোনোদিন মনে পড়ে বাবার স্মৃতিতে তবে হয়ত আমিও কোনো দিন সেই দ্যাশ দেখতে যাব.সেই আমাদের হারানো দ্যাশ.
সেই মধুমতি,পদ্মা,মেঘনা ও ভরা বরষায় ঈলিশ গন্ধে,গানে ও সুরে মম আমাদের হারানো দ্যাশ.নদীর দ্যাশ.গানের দ্যাশ.আমাদের বাপ ঠাকুরদা ঠাকুমাদের প্রাণের দ্যাশ.
জন্মান্তরে বিশ্বাস করিনা,তাই বলতে পারবো না শঙ্খচিল হয়ে ফিরে যাব সেই ধানক্ষেতের আলে,যেখানে লেখা আছে নক্শীকাঁথা.
তবু নক্সীকাঁথা দেখা হয়ে গেল অকস্মাত.
মরমে মরে যাই,যে বাবার প্রাণে এত ভালোবাসা ছিল,সেই বাবা ও তাঁর প্রজন্ম কেন যে দেশভাগ মেনে নিয়েছিল,যা আসলে তাঁরা কোনোদিন,কোনোদিন মনে প্রাণে মেনে নিতে পারেননি,তাঁদের রক্তনদীতে স্নান করে বড় হয়েছি,তাই আজও আমি রক্তাক্ত.
লিখতে বসলেই রক্ত.
কথা বলেই রক্ত.
এত রক্ত ,রাখি কোথায়.
ফুফুর ঔ চিঠি আমার দেখার কথা নয়.
সুমিত গুহ ভালো চিত্রকর.
দেশে বিদেশে তাঁকে লোকে চেনে.
আমি কলা চিত্রকলার কিছুই বুঝি না.
ঘটনাচক্রে সুমিত গত পচিশ বছর যাবত ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসে আমার সহকর্মী.বন্ধু ত বটেই.
কালই হাতে করে নিয়ে এসে বলল ,চিঠিখানি পড়.
পড়েই বুঝলাম,কাঁটাতারে সবকিছু আটকানো যায়,ভালোবাসা আটকানো যায়না.
পড়েই বুঝলাম,না জানি কত শত শত শত ফুফুদের ভালোবাসা থেকে আমাদের বন্চিত করেছে ঔ দেশ ভাগ.
তবু কেন মেনে নিতে হয় দেশ ভাগ,কে বোঝাবে,জানিনা.
ফুফুর চিঠি প্রকাশিত করার অধিকার হয়ত নেই.
তবু ভালোবাসা ছড়ানো দরকার.
ভালোবাসার আকালে স্মৃতিতে বিষবৃক্ষ রোপণ হয়েছে এত এত গভীরে যে এই চিঠির ভালোবাসা বিলিয়ে দেওয়া দরকার.
ফুফু মাফ করবেন.
ফুফু আপনি ত দেশভাগে হারিয়ে যাওয়া আমাদের সবার ফুফু.আপনার এই ভালোবাসা পাব বলেই,বেঁচে ছিলাম.