কেন এই বিএনপিকে দিয়ে হবে না
শাহাদত হোসেন বাচ্চু
অবশেষে হিসেব মেলানোর সময় এসেছে। বিএনপির ভেতরে এখন সেই প্রশ্নটিই প্রকাশ্য হয়েছে, যা গুঞ্জরিত হচ্ছিল জনান্তিকে। শেষতক প্রতিষ্ঠাকালীন মহাসচিব ও সাবেক রাষ্ট্রপতি ডা: বদরুদ্দোজা চৌধুরী এবং রাজনীতির অনেক ঘটন-অঘটন পটিয়সী ব্যারিষ্টার মওদুদ আহমেদ বলেই ফেলেছেন - 'এই বিএনপি দিয়ে হবে না'। যে কথাটি বলার কথা ছিল ২০০১-৬ মেয়াদে, বিএনপির কোন নেতাই তখন বলেননি যে, এই বিএনপি সেই বিএনপি নয়। কারণ বিএনপি তখন রাষ্ট্র ক্ষমতায়। দেশ শাসন করছেন তারেক জিয়া। হাওয়া ভবন তখন ক্ষমতার মূল কেন্দ্রে। এই নেতারাই ব্যস্ত তারেকের চাটুকারিতায় আর স্তাবকতায়। তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বি, চৌধুরীকে যখন তারেকের ইচ্ছায় অপসারণ করা হয় তখনও কেউই মুখ খোলেননি। এমনকি দল থেকে বের করে দেবার পরেও না। জঙ্গীবাদের উত্থানের সাথে বিএনপির অনেক নেতার নাম জড়িয়ে পড়লো, তখনও এই নেতৃত্ব মুখ খোলেনি। বরং বলে এসেছে, দেশে জঙ্গীবাদের অস্তিত্ব নেই, এটি মিডিয়ার সৃষ্টি।
২০০৪ সালে তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতার জনসভায় গ্রেনেড হামলার পরে তদন্ত বিচারের নামে যে নাটক সাজান হয়েছিল, বিএনপির এই নেতৃত্ব তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেননি। ২০০৬ সালে জিয়া হত্যায় কথিত অভিযুক্ত এরশাদের সাথে তারেক জিয়া যখন সহযোগিতার জন্য দেখা করেছেন, তখন ঐ নেতৃত্ব মুখে কুলুপ এঁটে বসেছিল। লালু, ভুলু, দুলু, ফালু,সাকা দিয়ে দেশ চালানো হচ্ছিল - সবাই বুঝেছিলেন এদের দিয়ে দেশ চলে না। বুঝতে পারছিলেন না শুধু খালেদা জিয়া ও তার পুত্র তারেক জিয়া। তাদের কেউ বোঝানোর দায়িত্ব নেয়নি যে, এই বিএনপি দিয়ে দেশ চলে না।
দলের, রাজনৈতিক নেতৃত্বের বদলে একক কর্তৃত্বে যেদিন হাওয়া ভবনের সৃষ্টি, সেদিন থেকেই শুরু হয় বিএনপির পতন, দল হিসেবে বিএনপি সামিল হয় বিনাশী যাত্রায়। তারেক জিয়া প্রধানমন্ত্রী না হয়েও দেশ ও দলকে ক্রমাগত বিপদের মধ্যে নিয়ে গেছেন - এ আলোচনা এখন যেমন বিএনপিতে অনেকটাই প্রকাশ্য, পদ-পদবী হারানোর ভয়ে মাতৃস্নেহান্ধ পুত্রের কর্মকান্ডের বিষয়ে কেউই মুখ খোলেননি। বরং তারেক জিয়া তাদের কাছে হয়ে উঠেছিলেন স্নেহের ভাতিজা, ভাইয়া, যুবরাজ, ক্রাউন প্রিন্স - দল ও দেশের ভবিষ্যত কান্ডারী। দুর্নীতি-দুর্বৃত্তায়নের ফাঁদে ফেলে ২০০১-৬ মেয়াদে দেশকে ক্রমাগত পিছিয়ে দি"িচ্ছলেন তারেক, মামুন,হারিস গং, সর্বোপরি বিএনপি-জামায়াত জোটের গাঁটছড়া। তখন রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠাকালীন বিএনপি নেতৃত্ব সবকিছুই মেনে নিয়েছিলেন অবলীলায়। বোঝেননি এই বিএনপি ভবিষ্যতে কোথায় গিয়ে দাঁড়াতে পারে!
২০০৭ সালে 'সেনা-সিভিল'অভ্যূত্থানে গঠিত সরকারের সময় একেবারেই বিপর্যস্ত, দল দু'ভাগ এবং ২০০৮ সালের নভেম্বরের নির্বাচনে পরাস্ত বিএনপি নেতৃত্ব বুঝতে পারেননি - এই বিএনপি দিয়ে হবে না। ২০১৫ সালের মাঝামাঝি সময়ে এসে এখন তারা বুঝতে পারছেন, হবে না, এই বিএনপি দিয়ে হবে না। এই বিএনপি অর্থাৎ তারেক জিয়ার বিএনপি দিয়ে হবে না। যে তারেক জিয়া হাওয়া ভবন গঠনের মাধ্যমে বিএনপির অনানুষ্ঠানিক মৃত্যু ঘটিয়েছিলেন, জন্ম দিয়েছিলেন আরেক বিএনপি যা কিনা শুরুতেই পড়ে গিয়েছিল দুর্নীতি, জঙ্গীবাদ, অর্থপাচার, যুদ্ধাপরাধী দলের পৃষ্ঠপোষকতার অতল গহবরে। তার প্রয়াত পিতা যে দলের জন্ম দিয়েছিলেন এবং তার মাতা আশির দশকের গোড়াতে চরম সংকটে যে দলকে রক্ষা করেছিলেন, এক দশকের কম সময় নিয়ে এসেছিলেন রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায়, সেই দলের বিনাশ ঘটেছে তারেক জিয়ার নেতৃত্বে। দেড় দশকে দলের এই হাল তিনি করে ছেড়েছেন - অবসন্ন, বিপর্যস্ত এবং দিকভ্রান্তহীন। পনের বছর পরে প্রতিষ্ঠাকালীন নেতৃত্বের মনে হয়েছে- এই বিএনপি দিয়ে আর সম্ভব নয়।
২০০৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপির করুণ পরাজয়ের কারণ দল হিসেবে তারা মূল্যায়ন করতে ব্যর্থ হয়েছে। তাদের কথা-বার্তায় মনে হয়েছে মঈনউদ্দিন-ফখরুদ্দিন আওয়ামী লীগের সাথে ষড়যন্ত্র করে ক্ষমতা তুলে দিয়ে গেছে। জনগণের ভূমিকা মূল্যায়ন না করে এবং নির্বাচনী ফল সম্পর্কে বস্তুনিষ্ঠ মূল্যায়ন না করে এই নেতিবাচক বক্তব্য কখনই জনগণের কাছে গ্রহনযোগ্য হয়নি। এ সময় থেকেই ২০১৫ সালের মার্চ পর্যন্ত দেশের রাজনীতিতে বিএনপি কখনই নেতিবাচক বক্তব্য বা কর্মকান্ড থেকে রেরিয়ে আসতে পারেনি। এ কারণে যেকোন আন্দোলন, সংগ্রাম,বক্তব্য সীমাবদ্ধ থেকেছে পরিবার ও ব্যক্তিকেন্দ্রিকতায় - যা জনসম্পৃক্ততা আনতে পারেনি। ২০০৯ সাল থেকে শুরু করে ২০১২ পর্যন্ত বিএনপি যতগুলি হরতাল করেছে, প্রায় সবগুলিই ছিল তারেক কেন্দ্রিক। ফলে সমর্থক জনগোষ্ঠির মধ্যে সৃষ্টি হয় স্থায়ী একটি পারসেপশন-খালেদা জিয়ার পুত্রস্নেহের কাছে পরাজিত হয়েছে দলের নীতি আদর্শ। অন্তত: যে দলের নেতৃত্ব দিয়েছেন তাঁর স্বামী প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়া এবং পরবর্তীতে তিনি। সম্ভবত: স্নেহের দায় বয়ে বেড়াতে হচ্ছে তাঁকে, দলকে, দেশকে-এর শেষ কোথায় সেটি তিনি নিজেও কি বলতে পারবেন?
২০০১ সাল থেকে ডি ফ্যাক্টো নেতা হিসেবে তারেক জিয়া দল চালিয়েছেন। এক্ষেত্রে তিনি সবসময় প্রধান্য দিয়েছেন হাওয়া ভবনের অনুসারীদের। দলের প্রতিষ্ঠাকালীন জেষ্ঠ নেতারা তার কাছে ছিলেন সবসময়ই উপেক্ষিত। ফলে ঐসব নেতারা দলীয় সিদ্ধান্তের সাথে যুক্ত থাকতে পারেননি। মিডিয়ায় কিছুটা সক্রিয় থাকলেও দলীয় কর্মকান্ডে তারা হয়ে পড়েন নিস্ক্রিয়। সাধারনত: ক্ষমতার বাইরে থাকাকালে দল আরো সংগঠিত থাকে। নেতা-কর্মীদের মধ্যে দুরত্ব কমে যায়, সমঝোতা-সমন্বয় বাড়ে। বিএনপির তৃণমূলে সমন্বয়-সমঝোতা থাকলেও কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে সেটি দীর্ঘদিন ধরে অনুপস্থিত। এমনকি বিএনপির দলীয় সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে স্ট্যান্ডিং কমিটি, খোদ খালেদা জিয়াকেও কিংকর্তব্যবিমূঢ় দেখা গেছে। এর সবচেয়ে বড় উদাহরন হচ্ছে, ২০১৫ সালের ৫ জানুয়ারি অবরুদ্ধ খালেদা জিয়ার আন্দোলন কর্মসূচি ঘোষণা। এটি জনগণের কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল যে, তিনি লাগাতার যে কর্মসূচির ঘোষণা দিলেন সেটি তাঁর কাছেও পরিস্কার নয়।
অন্যদিকে, দেশের অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক দল হিসেবে গত আট বছরে দলটিতে একজন স্থায়ী মহাসচিব নিয়োগ দেয়া হয়নি, কারণ এই নিয়োগ নির্ভর করে তারেক জিয়ার মতামতের ওপর। এজন্যই দলীয় প্রধান হিসেবে খালেদা জিয়ার অনেক সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও দলীয় নেতৃত্ব জানেন, এক্ষেত্রে মাতৃস্নেহ প্রভাবক হিসেবে কাজ করে, সেজন্য এ নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়না। আওয়ামী লীগকে মোকাবেলা করতে তিনি যে ২০ দলীয় জোটটি গঠন করেছেন সেখানে প্রায় সব দলই নামসর্বস্ব। এর মধ্যে রয়েছে যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত জামায়াত, মৌলবাদী ৪টি দল, রয়েছে দন্ডিত আসামীর দলসহ বেশ কয়টি ছোট ছোট নামসর্বস্ব দল এবং তারা বিএনপির জন্য সম্পদ না হয়ে দায় হয়ে দাড়িয়েছে। এদের নিয়ে জোট করে বিএনপি কতটা লাভবান হয়েছে, সেটা তারাই ভাল বলতে পারবেন। কিন্তু পুরোনো জোট শরিক জামায়াতকে সাথে রেখে তাদের কৃত যুদ্ধাপরাধসহ সকল অপকর্মের দায় বিএনপিকেই বহন করতে হচ্ছে।
সামরিক শাসক এরশাদকে বৈধতা দেয়ার জন্য ১৯৮৬ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচন বয়কট করে অসামান্য রাজনৈতিক প্রজ্ঞার পরিচয় দিয়েছিলেন খালেদা জিয়া। তাঁর এ অনমনীয়তা এবং সামরিক শাসন বিরোধী আন্দোলনে দৃঢ়তা নেতৃত্বের এক উঁচুমাত্রায় তাঁকে প্রতিষ্ঠিত করেছিল। যার ফল তিনি পেয়েছিলেন ১৯৯১ সালের জাতীয় নির্বাচনে। বিএনপি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসীন হয়েছিল। দলীয় গঠনতন্ত্রে রাষ্ট্রপতি শাসিত পদ্ধতি থাকা সত্বেও সংসদীয় পদ্ধতির সরকার ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে তিনি মুখ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন। নানা সীমাবদ্ধতা ও রাষ্ট্র পরিচালনায় নতুন হলেও ১৯৯১-৯৬ মেয়াদে খালেদা জিয়া রাজনৈতিক পরিপক্কতার পরিচয় দিয়েছিলেন। কিন্তু প্রবল সম্ভাবনার মুখে দাঁড়িয়ে সংসদীয় পদ্ধতির বদলে প্রধানমন্ত্রী শাসিত সরকারই কায়েম করেছিলেন,যা ছিল সামরিক শাসন বিরোধী আন্দোলনের মূলগত আকাঙ্খার বিপরীত।
ইতিহাস সাক্ষ্য দেবে, গণতান্ত্রিক কাঠামোবিহীন একটি দল এবং সরকারে তাঁর একক কর্তৃত্ব ও নেতৃত্ব মধ্যপন্থী দল হিসেবে বিকাশের বদলে বিএনপিকে পেছনে নিয়ে যেতে থাকে। দলের মধ্যে দেখা দেয় ডানপন্থার প্রতি প্রবল ঝোঁক। পরিনামে জামায়াতের সাথে জোটবদ্ধতা ও পরবর্তীকালে জঙ্গীবাদকে পৃষ্ঠপোষকতার দায় নিতে হয় মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান প্রতিষ্ঠিত এবং সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ঋদ্ধ দল বিএনপিকে। সাথে যুক্ত হয় তার পুত্রের রাজনৈতিক অপরিনামদর্শিতা এবং সকল ক্ষমতা কুক্ষিগত করার প্রবণতা। এজন্যই ঠিক দুই যুগ পরে প্রায় ৩৫ শতাংশ জনসমর্থনপুষ্ট এই রাজনৈতিক দল এখন অস্তিত্ব রক্ষার লড়াইয়ে লিপ্ত। যুদ্ধাপরাধ, জঙ্গীবাদ, দুর্নীতির বিরুদ্ধে অবস্থান পরিস্কার করতে না পারা এবং ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দলটিকে বিপর্যস্ত করে তোলে। এ অবস্থায় বিএনপি নেতৃত্ব মূল্যায়ন করতে সক্ষম হয়েছে যে, ৩ দফা আন্দোলনে চরম ব্যর্থতার পরে এই বিএনপি দিয়ে হবে না।
কি হবে বিএনপির আগামী রাজনৈতিক কৌশল? প্রবল প্রতিপক্ষ আওয়ামী লীগ এবং কর্তৃত্ববাদী এই সরকারের মোকাবেলায় জনগণকে সম্পৃক্ত করতে কি লক্ষ্যভেদী কৌশল তারা নির্ধারন করবেন - সেটিই এখন রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের কাছে সবচেয়ে বড় কৌতুহলের বিষয়। সবসময়ই বড় ধরনের সংকট সুযোগও সৃষ্টি করে থাকে। বড় প্রমান হচ্ছে,১৯৮২ সালের পরে ধ্বংসস্তূপ থেকে বিএনপিকে দেশের অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন খালেদা জিয়া। এক অর্থে নতুন রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিল বিএনপি। পর্যবেক্ষণের বিষয় হচ্ছে, আগামীতে তারা জনগণের শক্তিতে বলীয়ান হয়ে রাজনীতির মাঠে ফিরে আসতে পারবেন, নাকি বরন করবেন অতীতের মুসলিম লীগ বা ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির করুণ পরিণতি?