২০০৩ থেকে ২০১২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত গত এক দশকে বাংলাদেশ থেকে এক হাজার ৩১৬ কোটি ৪০ লাখ ডলার বা প্রায় এক লাখ পাঁচ হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার করা হয়েছে। এই টাকার অঙ্ক বাংলাদেশের চলতি অর্থবছরের বাজেটের প্রায় ৪০ শতাংশ। অর্থাৎ গড়ে বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর ১৩২ কোটি ডলার বা ১০ হাজার ৫০০ কোটি টাকার মতো পাচার হচ্ছে। এর মধ্যে ২০১২ সালে বাংলাদেশ থেকে পাচার করা হয়েছে ১৭৮ কোটি ডলার বা ১৪ হাজার ২৪০ কোটি টাকা। ২০১২ সালে পাচার হওয়া অর্থের পরিমাণ আগের দুই বছরে (২০১০ ও ২০১১) পাচার হওয়া অর্থের সমষ্টিরও বেশি। ২০১২ সালে যে অর্থ পাচার হয়েছে, তা ওই বছরের জিডিপির প্রায় ১ শতাংশ এবং পদ্মা সেতু নির্মাণ প্রকল্প ব্যয়ের অর্ধেকেরও বেশি।
দেখা গেছে, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা বেশি থাকলে দেশ থেকে অর্থপাচারও বাড়ে। ২০০৬ সালে দেশ থেকে সবচেয়ে বেশি অর্থপাচার হয়, যার পরিমাণ ২৬৬ কোটি ৭০ লাখ ডলার। ওয়ান-ইলেভেনের সময় ২০০৭ সালে বাংলাদেশ থেকে পাচার করা হয়েছে ২৪৩ কোটি ৬০ লাখ ডলার। আর ২০০৮ সালে তা কমে দাঁড়ায় ১২২ কোটি ৯০ লাখ ডলারে। আর ২০০৯ সালে নতুন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর অর্থপাচারের পরিমাণ আরো কমে দাঁড়ায় ১০৬ কোটি ৩০ লাখ ডলারে।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক অর্থপাচারবিরোধী আন্তর্জাতিক সংস্থা গ্লোবাল ফিন্যানশিয়াল ইন্টিগ্রিটি (জিএফআই) গতকাল ১৬ ডিসেম্বর, মঙ্গলবার বিশ্বজুড়ে অর্থপাচারের তথ্যসংবলিত নতুন প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। তাতে বাংলাদেশ থেকে বিদেশে অর্থপাচারের এসব তথ্য উঠে এসেছে। তবে সংস্থাটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে পাচার হওয়া অর্থের অঙ্ক নির্ধারণ করা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে পাচার হওয়া অর্থের পরিমাণ আরো বেশি।
বাংলাদেশ থেকে পাচার হওয়া অর্থের বেশির ভাগই পাচার হচ্ছে আমদানি-রপ্তানির সময় পণ্যের মূল্য বেশি বা কম দেখিয়ে। অর্থাৎ কম দামে বিদেশ থেকে পণ্য কিনে বেশি দাম দেখিয়ে (ওভার ইনভয়েসিং) অর্থ পাচার করা এবং বেশি মূল্যে রপ্তানি করে কম মূল্য দেখিয়ে (আন্ডার ইনভয়েসিং) বাড়তি টাকা বিদেশেই রেখে দেওয়ার মাধ্যমে অর্থপাচার হচ্ছে। গত দশকের প্রথম দিকে বেশির ভাগ অর্থই পাচার হয়েছে আমদানি-রপ্তানির সময়। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নগদ অর্থপাচারের পরিমাণ বেড়ে গেছে। ২০১২ সালে পাচার হওয়া ১৭৮ কোটি ডলারের মধ্যে নগদ আছে ১০২ কোটি ৬০ লাখ ডলার। আর ৭৫ কোটি ৫০ লাখ ডলার পাচার হয়েছে আমদানি-রপ্তানি পণ্যের মূল্যে কারসাজির মাধ্যমে।
জিএফআইর প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিশ্বের ১৪৭টি দেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশি অর্থপাচারকারী দেশগুলোর তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ৫১তম আর দক্ষিণ এশিয়ায় দ্বিতীয়। এ অঞ্চলে শীর্ষ অর্থপাচারকারী বিবেচনায় ভারতের পরেই বাংলাদেশের নাম এসেছে। গতবারের প্রতিবেদনে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ৪৭তম। গতবারের চেয়ে এবার চার ধাপ উন্নতি হলেও অর্থপাচার আগের চার বছরের তুলনায় বেড়েছে। মূলত অন্যান্য দেশ থেকে অর্থপাচার আরো বেশি হারে বাড়ার কারণে বাংলাদেশ চার ধাপ এগোতে পেরেছে। প্রতিবেদন মতে, বিশ্বে সবচেয়ে বেশি অর্থ পাচার হয় চীন থেকে, আর সবচেয়ে কম পাচারকারী দেশ সেনেগাল। শীর্ষ পাচারকারী দেশগুলোর তালিকায় ভারতের অবস্থান চীন, রাশিয়া ও মেক্সিকোর পরেই।
২০০৬ সাল থেকে জিএফআই নিয়মিতভাবে অর্থপাচার বিষয়ে বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এবারের প্রতিবেদনটি তৈরি করেছেন সংস্থাটির প্রধান অর্থনীতিবিদ ডেভ কার ও জুনিয়র অর্থনীতিবিদ জোসেফ স্পেনজার্স। তাঁদের মধ্যে ডেভ কার জর্জ ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটি থেকে অর্থনীতিবিদ্যায় পড়াশোনা করে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) সিনিয়র অর্থনীতিবিদ হিসেবে ৩২ বছর দায়িত্ব পালন করেছেন।
জিএফআইয়ের প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, আগের বছরগুলোতে আমদানি-রপ্তানি পণ্যের মূল্যে কারসাজির মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে বেশি অর্থপাচার হতো। কিন্তু কয়েক বছর ধরে নগদ অর্থপাচারের পরিমাণ অনেক বেড়ে গেছে। তবে আইনি ঝামেলা বা তথ্য-প্রমাণ যাতে না থাকে, সে জন্য নগদে পাচার করা অর্থ ব্যাংকের মাধ্যমে লেনদেন করা হয় না।
প্রতিবেদনটি বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, রাজনৈতিক অস্থিরতার আশঙ্কা যত বেশি থাকে, দেশ থেকে অর্থপাচারও তত বাড়ে। আর রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার আভাস থাকে- এমন বছরগুলোতে অর্থপাচার কমে যায়। গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার আশঙ্কায় ২০১২ সালে অর্থপাচার বিপুল হারে বেড়ে যায়। ওই বছর বাংলাদেশ থেকে ১৭৮ কোটি ডলার পাচার হয়েছে। অথচ ২০১১ সালে পাচার হওয়া অর্থের পরিমাণ ছিল ৫৯ কোটি ৩০ লাখ ডলার। ২০১০ সালে এর পরিমাণ ছিল ৬৭ কোটি ২০ লাখ ডলার।
একইভাবে রাজনৈতিক অস্থিরতার আশঙ্কায় ২০০৫ সাল থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচার হতে থাকে। ওই বছর ১০৫ কোটি ৪০ লাখ ডলার পাচার হয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যুতে ২০০৬ সাল থেকেই দেশের রাজনীতি অস্থির হয়ে ওঠে। এর পরিপ্রেক্ষিতে ওই বছর বাংলাদেশ থেকে সবচেয়ে বেশি অর্থ পাচার হয়, যার পরিমাণ ২৬৬ কোটি ৭০ লাখ ডলার। ২০০৭ সালে সৃষ্ট ওয়ান-ইলেভেনের সময়ও অর্থ পাচার হয়েছে বেশি। ওই বছর বাংলাদেশ থেকে পাচার হয়েছে ২৪৩ কোটি ৬০ লাখ ডলার। তবে ২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার নির্বাচনের দিকে এগোতে থাকায় রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার আলামত মেলে। ফলে আগের দুই বছরের তুলনায় ওই বছর অর্থপাচার কমে দাঁড়ায় ১২২ কোটি ৯০ লাখ ডলারে। আর ২০০৯ সালে নতুন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর অর্থপাচারের পরিমাণ আরো কমে দাঁড়ায় ১০৬ কোটি ৩০ লাখ ডলারে। এর আগে ২০০৩ সালে ৮৩ কোটি ডলার ও ২০০৪ সালে ৮৪ কোটি ডলার দেশ থেকে পাচার হয়েছে।
জিএফআইয়ের প্রতিবেদন অনুযায়ী, আমদানি-রপ্তানি মূল্যে কারসাজি করে (ওভার ইনভয়েসিং ও আন্ডার ইনভয়েসিং) ২০০৩ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত মোট ৮০৫ কোটি ৮০ লাখ ডলার বা ৬৪ হাজার ৪৬৪ কোটি টাকার মতো পাচার হয়েছে। অর্থাৎ প্রতিবছর আমদানি-রপ্তানি মূল্যের আড়ালে গড়ে প্রায় সাড়ে ছয় হাজার কোটি টাকা পাচার হয় বাংলাদেশ থেকে।
ওভার ইনভয়েসিং ও আন্ডার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে ২০১২ সালে পাচার হয়েছে ৭৫ কোটি ৫০ লাখ ডলার। ২০১১ সালে বাংলাদেশ থেকে এভাবে অর্থপাচারের কোনো তথ্য পায়নি জিএফআই। তবে ২০১০ সালে এভাবে ২৭ কোটি ডলার, ২০০৯ সালে ৩৬ কোটি ৬০ লাখ ডলার, ২০০৮ সালে ৯১ কোটি ১০ লাখ ডলার, ২০০৭ সালে ১৬৭ কোটি ৯০ লাখ ডলার, ২০০৬ সালে ২০২ কোটি ৩০ লাখ ডলার, ২০০৫ সালে ৪১ কোটি ডলার, ২০০৪ সালে ৮১ কোটি ৪০ লাখ ডলার এবং ২০০৩ সালে ৮৩ কোটি ডলার পাচার হয়েছে বাংলাদেশ থেকে।
জিএফআইয়ের প্রতিবেদন মতে, ২০০৩-১২ পর্যন্ত সময়ে আমদানিকারকরা ওভার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে ১২১ কোটি ৪০ লাখ ডলার ও আন্ডার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে ৫৭৭ কোটি ৪০ লাখ ডলার পাচার করেছে। আর রপ্তানিকারকরা ওভার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে ১৪৬ কোটি ২০ লাখ ডলার ও আন্ডার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে ৬৮৪ কোটি ৪০ লাখ ডলার পাচার করেছে।
সংস্থাটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০০৩-১২ সময়ে বাংলাদেশ থেকে ৫১০ কোটি ৩০ লাখ ডলার বা ৪০ হাজার ৮২৪ কোটি টাকা নগদ অর্থ পাচার হয়েছে। অর্থাৎ গড়ে প্রতিবছর চার হাজার ৮২ কোটি টাকা নগদ পাচার হচ্ছে। বছরওয়ারি নগদ পাচার হওয়া অর্থের মধ্যে ২০১২ সালে ১০২ কোটি ৬০ লাখ ডলার, ২০১১ সালে ৫৯ কোটি ৩০ লাখ ডলার, ২০১০ সালে ৪০ কোটি ২০ লাখ ডলার, ২০০৯ সালে ৬৯ কোটি ৭০ লাখ ডলার, ২০০৮ সালে ৩১ কোটি ৭০ লাখ ডলার, ২০০৭ সালে ৭৫ কোটি ৬০ লাখ ডলার, ২০০৬ সালে ৬৪ কোটি ৩০ লাখ ডলার, ২০০৫ সালে ৬৪ কোটি ৪০ লাখ ডলার ও ২০০৪ সালে আড়াই কোটি ডলার নগদ অর্থ পাচার হয়েছে।
http://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2014/12/17/164006