পাকিস্তানি সেনারা আমাদের ময়মনসিংহের বাড়িতে ঢুকেছিল একাত্তরের এক মধ্যরাতে. বাবাকে বেঁধেছিল নারকেল গাছের সঙ্গে, আধমরা করেছিল মেরে. লুট করেছিল আমাদের বাড়িঘর, টাকা পয়সা সোনা রুপো যা ছিল নিয়ে গিয়েছিল. আমরা শহর ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলাম. দীর্ঘ ন' মাস ছিলাম গৃহহীন. গ্রাম গঞ্জে অচেনা মানুষের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছি. গরুর গাড়িতে চড়ে রাতের অন্ধকারে এক গ্রাম থেকে আরেক গ্রামে গিয়েছি. কত কত দিন খেতে পাইনি, ঘুমোবার জন্য বিছানা পাইনি. অপেক্ষা করতাম কবে যুদ্ধ শেষ হবে.
যুদ্ধ শেষ হয়েছিল একদিন. আমরা ফিরেছিলাম আমাদের বাড়িতে, আমাদের শহরে, একটি নতুন দেশে. সে কী উত্তেজনা আমাদের তখন! সেই দেশটি কিন্তু পাকিস্তানি সেনাদের দোসর দ্বারা নষ্ট হতে খুব বেশিদিন সময় নেয়নি. ওরাই তো মিলে মিশে তিরিশ লক্ষ মানুষকে হত্যা করেছিল আর দু'লক্ষ মেয়েকে ধর্ষণ করেছিল.
দেশটি এমনই নষ্ট হয়েছে যে, পাকিস্তান পন্থীরাই এখন রাজত্ব করছে , তাবড় তাবড় সরকারও ওদের খুশি করে চলে. ওদের খুশি করতেই আমাকে (এক ডাক্তারকে,এক লেখককে, এক খাঁটি মানুষকে,যে মানুষ মুক্তিযুদ্ধের চেতনা লালন করে; গণতন্ত্রে, সমাজতন্ত্রে, ধর্মনিরপেক্ষতায় বিশ্বাস করে, যে মানুষ মানুষের মঙ্গল ছাড়া কোনো অমঙ্গল করেনি কখনো) দেশ থেকে বের করে দিয়েছে. দেশটিকে এমনই নষ্ট করেছে পাকিস্তানপন্থীরা আর মেরুদন্ডহীন শাসকেরা যে, পাকিস্তানের বর্বর সেনারাও আজ চমকে উঠবে দেশটিকে দেখে. তারাও বোধ হয় এই দেশটিকে এতটা নষ্ট করার দু:স্বপ্ন দেখেনি. তারাও বোধ হয় দেশটিকে এতটা টুপি হিজাবের দেশ বানাতে চায়নি.
দেশটির জন্মের সময় উত্সব করেছিলাম, ৪৩ বছর আগে, ১৬ ডিসেম্বর তারিখে. দেশটির মৃত্যুতে বিষম দু:খ করেছি. দেশটি আমার কাছে আজ মৃত. এ কথা সত্য আমার কোনো দেশ নেই. তবে এখনো কিছু মানুষ আছে দেশে, যারা ভালোবেসে দেশটিকে বদলাতে চায়, বাসযোগ্য করতে চায়, সেই মানুষগুলোই আমার দেশ, আমার প্রিয় স্বদেশ.