প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, তেলবাহী এই ট্যাংকারডুবির কারণে চরম হুমকিতে পড়েছে প্রায় ৩৭৫ প্রজাতির বন্য ও পানিজ প্রাণী। এর মধ্যে ৩২ প্রজাতির স্তন্যপায়ী, ৩৫ প্রজাতির সরীসৃপ, ৩০০ প্রজাতির পাখি এবং ৮ প্রজাতির উভচর প্রাণী রয়েছে। এছাড়া ৩৩৪ প্রজাতির গাছগাছালি, ১৬৫ প্রজাতির শৈবাল এবং ১৩ প্রজাতির অর্কিডও পড়েছে একই ধরনের হুমকিতে। কারণ ম্যানগ্রোভ বনের এসব উদ্ভিদ শ্বাসমূল দিয়ে অক্সিজেন গ্রহণ করে থাকে। ডুবে যাওয়া ট্যাংকার থেকে ফার্নেস অয়েল দ্রবীভূত হওয়ায় ওই এলাকার পানিতে অক্সিজেনের পরিমাণ কমে গেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পানিতে অক্সিজেনের পরিমাণ কমে যাওয়ার কারণে এসব উদ্ভিদ স্বাভাবিক শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে পারছে না। এজন্য সুন্দরবনের ওই এলাকায় ভয়াবহ বিপর্যয় নেমে আসতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
উল্লেখ্য, আন্তর্জাতিক নিয়ম অনুযায়ী সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে বাণিজ্যিক নৌযান চলাচল নিষিদ্ধ। দেশের বণ্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইন এবং পরিবেশ সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী সেখানে এভাবে নৌযান চলাচল করতে পারে না। ২০১১ সালে সব কিছুকে উপেক্ষা করে সরকারের নৌপরিবহন অধিদফতর সেখানে নৌপথ চালু করে দিয়েছে। শুরুতে অল্প কিছু জাহাজ চলাচল করলেও এখন প্রতিদিন ২৫০টি পর্যন্ত জাহাজ চলাচল করছে এ রুটে। অথচ সুন্দরবনে মংলা থেকে বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত ১২০ কিলোমিটার এলাকায় আট প্রজাতির ডলফিনের বিচরণ। ওয়াইল্ড লাইফ কনজারভেশন সোসাইটির জরিপ অনুযায়ী সবচেয়ে অল্প পানিজ ভূমির মধ্যে বেশি প্রজাতির ডলফিন বিচরণ এলাকা এটি। রয়েল বেঙ্গল টাইগারসহ ১৫ প্রজাতির প্রাণী এ এলাকায় বিচরণ করে থাকে। এখন এসব প্রাণী বিলুপ্ত হওয়ার আশঙ্কার মধ্যে রয়েছে। উল্লেখিত দুর্ঘটনাস্থল মংলা বন্দরের জেটি থেকে ৯ নটিক্যাল মাইল দূরে। দুর্ঘটনার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই সুন্দরবনের ২০ কিলোমিটার এলাকায় জ্বালানি তেল ছড়িয়ে পড়েছে। এর আগেও দুটি বাণিজ্যিক জাহাজের দুর্ঘটনা ঘটেছিল সুন্দরবনে। গত ৩০ সেপ্টেম্বর-২০১৪ ঈসায়ী তারিখে ৬০০ মেট্রিক টন সিমেন্টের কাঁচামাল নিয়ে একটি জাহাজ পশুর চ্যানেল এলাকায় ডুবেছে। ১২ সেপ্টেম্বর-২০১৪ ঈসায়ী তারিখে অন্য একটি জাহাজ একই ধরনের পণ্য নিয়ে ওই পয়েন্টে ডুবে যায়। অথচ বাণিজ্যিক পণ্য পরিবহনের জন্য ভিন্ন একটি রুট রয়েছে। সেটি সংস্কার করে সে পথে পণ্য চলাচল করার সুযোগ রয়েছে। মারাত্মক অবহেলার কারণে সুন্দরবনের প্রাকৃতিক পরিবেশের বিপর্যয় ঘটিয়ে বনের বুক চিরে অবাধে বাণিজ্যিক জাহাজ চলাচল করছে।
আশ্চর্যের বিষয় হলো, দুর্ঘটনার পর ১২ ঘণ্টা পার হয়ে যাওয়ার পর বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান ঘটনা জানতে পারেন। এবং সে পর্যন্ত জাহাজ উদ্ধার ও তেল অপসারণের কোনো উদ্যোগও নেয়া হয়নি। বিভিন্ন প্রক্রিয়ার পর ৪৮ ঘণ্টা পর চট্টগ্রাম থেকে উদ্ধারকারী জাহাজ রওয়ানা দেয়। ততক্ষণে সম্পূর্ণ বেসরকারি উদ্যোগে দেশীয় পদ্ধতিতে জাহাজমালিক স্থানীয়দের সহায়তায় জাহাজ উদ্ধার করে ফেলে। অথচ সরকারি কর্তৃপক্ষ থাকলো পুরো উদাসীন। অর্থাৎ এ ঘটনার বিপর্যয়ের দিকটি বোঝার সক্ষমতাও অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের নেই। এ দুর্ঘটনার পর জানা গেল, বাংলাদেশে কোনো অয়েল সুইপার নৌযান নেই। প্রশ্ন উঠে- এরা কি এদেশের হিতাকাঙ্খী, নাকি ভারত হিতৈষি এবং এদেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারী।
বিশ্ববাসী বাংলাদেশকে চেনে বেঙ্গল টাইগার দিয়ে। বিপন্ন প্রজাতির সেই বাঘের বংশ ধ্বংসের নতুন এই উপদ্রব শুরু করেছে নৌপরিবহন অধিদপ্তর। এদের স্বেচ্ছাচারিতা বন্ধ না করলে সুন্দরবন বাঁচবে না। এদিক থেকে ইউনেস্কো অনেকবার চিঠি দিয়েছে বাংলাদেশকে। এরকম হলে সুন্দরবনকে আর বিশ্ব ঐতিহ্যের জায়গায় আর দেখা নাও যেতে পারে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, সারাবিশ্বে তেল পরিবহনের কাজটি করা হয় বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থা মাথায় রেখে। কারণ এ জাতীয় দুর্ঘটনা শুধু সম্পদেরই ক্ষতি করে না, পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যেরও অপূরণীয় ক্ষতি করে থাকে। অথচ আমাদের দেশে এ ক্ষেত্রে চরম ঔদাসীন্য ও অপরিণামদর্শিতা দেখিয়ে যাওয়া হচ্ছে, যার পরিণামই এই বিপর্যয়। এর দায় কোনোভাবেই নিশ্চয় সংশ্লিষ্টরা এড়াতে পারে না।
গত এক দশকে সুন্দরবন এলাকায় লবণাক্ততা বেড়েছে ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ। বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, আবহাওয়া পরিবর্তন ও লবণাক্ততার প্রভাবে আগামী দু'দশক নাগাদ সুন্দরবন থেকে সুন্দরী গাছ বিলীন হয়ে যেতে পারে। দেশের অন্তত ৪০ লাখ মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সুন্দরবনের প্রাকৃতিক সম্পদের উপর নির্ভরশীল। কাজেই তেলবাহী জাহাজডুবির ফলে সৃষ্ট ক্ষয়ক্ষতি দ্রুত কমিয়ে আনাসহ ভবিষ্যতে এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে ব্যবস্থা নেয়া জরুরী।
অপার সম্পদরাজিতে ঐশ্বর্যম-িত সুন্দরবন কিছু মানুষের দুর্বৃত্তপনায় বা অপরিণামদর্শিতায় ধ্বংস হয়ে যাবে, এটা কোনোভাবেই মেনে নেয়া যায় না। সুন্দরবনের সম্পদ সংরক্ষণে আজ পর্যন্ত সঠিক কোনো নীতিমালা ও পরিকল্পনা বাস্তবায়নের দৃষ্টান্ত নেই। বিষয়টি অত্যন্ত পীড়াদায়ক। সুন্দরবনকে তার স্বাভাবিক রূপ ও প্রাণপ্রবাহে ফিরিয়ে আনতে এখনই উদ্যোগ নিতে হবে।
বাংলাদেশ ভূখণ্ডের সুন্দরবন ধ্বংসের নীলনকশা বাস্তবায়ন হচ্ছে।
রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনসহ সুন্দরবনে একের পর এক ভারী জাহাজডুবি কি তারই প্রমাণ নয়?
সুন্দরবন ধ্বংস মানে বাংলাদেশ ধ্বংস- এ কথা এদেশের সরকার না বুঝলে ভারত ঠিকই বোঝে ও ষড়যন্ত্র করে।
মূলত, সব সমস্যা সমাধানে চাই সদিচ্ছা ও সক্রিয়তা তথা সততা।
|