দুর্নীতি বাড়ার নেপথ্যে
'এক সময় দুর্নীতিতে আমরা চ্যাম্পিয়ন ছিলাম। এখন সেটা নেই। এ বিষয়ে ভারত-বাংলাদেশের অবস্থান এখন কাছাকাছি। আমাদের পয়েন্ট ২৫, ভারতের ৩৪'। বিশ্বব্যাপী দুর্নীতির ধারণা সূচক - ২০১৪ প্রতিবেদনে বাংলাদেশে দুর্নীতি বাড়ার সরকারের পক্ষে এভাবেই নিজেদের অবস্থান তুলে ধরেন তোফায়েল আহমেদ। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল এর দুর্নীতির ধারণা সূচকে (সিপিআই) নিচের দিক থেকে বিশ্বে সর্বোচ্চ স্থান অর্জন বা চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরবটি জাতির ললাটে প্রথম আঁকা হয়েছিল ২০০১ সালে। পরবর্তীতে ২০০৫ সাল পর্যন্ত এ ধারাবাহিকতা বজায় ছিল। উল্লেখ্য, প্রতি বছরের সূচকে বিগত কয়েক বছরে সংঘটিত দুর্নীতির ওপর ধারণার গড় হিসাবে পরিমাপ করা হয়। সে হিসাবে ২০০১ সালে সূচকের মানের ওপর ২০০০ সালে সংঘটিত দুর্নীতির প্রভাব রয়েছে, তেমনি ২০০১ এর সূচকের মানের ওপর ২০০০ এবং ২০০১ সালে ভিত্তিতে সংঘটিত দুর্নীতির ঘটনার সরাসরি প্রভাব রয়েছে। এ প্রেক্ষিতে এটা নিঃসন্দেহে বলা যায় ২০০১ থেকে ২০০৫ পর্যন্ত সিপিআই এ বাংলাদেশের অর্জিত স্কোরের ক্ষেত্রে প্রধান দু' দলের প্রায় সমান অবদান রয়েছে।
২০১৪ সালে শূন্য থেকে ১০০ পয়েন্ট স্কেলে ২৫ পয়েন্ট (গত বছরে যা ছিল ২৭) পেয়ে বাংলাদেশ ১৭৫টি দেশের মধ্যে ১৪৫তম অবস্থানে নেমে আসে। ২০১৩ সালের তুলনায় ২০১৪ সালে তালিকার উচ্চক্রম অনুযায়ী বাংলাদেশের ৯ ধাপ অবনতি এবং নিম্নক্রম অনুযায়ী ২ ধাপ নিচে(১৬তম স্থান থেকে নেমে ১৪তম স্থানে) অবস্থান গ্রহণ করেছে বাংলাদেশ। সবচেয়ে উল্লেখ্য যে, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে আফগানিস্তানের পর বাংলাদেশ দ্বিতীয় সর্বনিম্ন অবস্থানে রয়েছে, এমনকি পাকিস্তানও বাংলাদেশের ওপরে অবস্থান করছে। ২০১৩ সাল থেকে দুর্নীতির ধারণা সূচক পরিমাপ পদ্ধতি পরবির্তন হয়ে ১০ এর জায়গায় ১০০ তে পরিমাপ করা শুরু হয় এবং কিন্তু বাস্তব অবস্থার চিত্র কিছুটা উন্নতি দেখালেও তা যে সাময়িক তা ২০১৪ সালের সূচকের মানে ফুটে ওঠেছে।
সৌভাগ্য যে বাংলাদেশের সূচকের মান আরো কম হতে পারতো। সুচকে ব্যবহৃত ৭টি উৎসের মধ্যে ৬টির গড় নম্বর ১০০ এর মধ্যে ১৮-২৩ নম্বর দিলেও অন্য প্রতিষ্ঠানটি (ICRG-PRS) ৫০ নম্বর দেয়ায় বংলাদেশের গড় স্কোর দাড়ায় ২৫ এ। এ প্রতিষ্ঠানটি যদি অন্য ৬টির মধ্যে সর্বোচ্চ প্রাপ্ত গড় নম্বর ২৩ থেকে তাহলে বাংলাদেশের গড় নম্বর দাড়াতো ২১ এর কাছাকাছি। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান নিচের দিক থেকে ১০ম হতো। উল্লেখ্য, সংগৃহীত তথ্যের সময়ের ব্যাপ্তি ছিল ফেব্রুয়ারি ২০১১ থেকে আগস্ট ২০১৪ পর্যন্ত। সুতরাং এ সূচকের অবনতি ওই সময়কালে বাংলাদেশে দুর্নীতির বিস্তার এবং দুর্নীতি রোধে ব্যর্থতার প্রাথমিক চিত্র।
দুর্র্নীতির বিস্তারের শুরু অনেক আগেই ঘটে। কানাডা, দুবাই, মালয়েশিয়া সহ বিভিন্ন দেশে হাজার কোটি টাকা পাঁচার করা হয়েছে। শেয়ার বাজারে কারসাজি, হল-মার্ক কেলেংকারি, রেন্টাল বিদ্যুত কেন্দ্র ও গ্যাস ব্লক ইজারা, পদ¥া সেতু নির্মাণে দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের অভিযোগ, হলমার্ক,বেসিক ব্যাংকসহ রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাট, রেলওয়ের নিয়োগ বাণিজ্য, ডেসটিনির ১৪০০ কোটি টাকা লোপাট, টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ উপলক্ষে অর্থ মন্ত্রীর প্রকাশ্যে চাঁদা গ্রহণ এবং অবৈধভাবে নির্মিত রানা প্লাজার দুর্ঘনায় শত শত শ্রমিক হত্যার নায়ক রানা এবং তার গডফাদার তৎকালীন এমপির ঘটনাসহ হাজার হাজার কোটি টাকার দুর্নীতির সাথে রাজনৈতিক এবং প্রভাবশালী ক্ষমতাধরদের জড়িত থাকার সুস্পষ্ট অভিযোগ সত্ত্বেও বিগত ছয় বছরে দুদক এসব দুর্নীতির কোন অনুসন্ধান করেনি। এমনকি বর্তমান সরকার ২০০৯ সালে ক্ষমতা গ্রহণের পর প্রধানমন্ত্রীর ১৫টি দুর্নীতির মামলা সহ মন্ত্রী, এমপি এবং নেতাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলা দুদকের সহায়তায় গণহারে 'রাজনৈতিক বিবেচনায়' প্রত্যাহার করে।
সর্বশেষ, গত ৫ জানুয়ারির বিতর্কিত নির্বাচনের প্রায় একশ'র বেশি এমপি প্রার্থীর নির্বাচনী হলফনামায় অস্বাভাবিক সম্পদ দেখালে তার অনুসন্ধানে দুদক কারো দুর্নীতি তো খুঁজেই পাচ্ছেনা উল্টো একের পর এক অভিযুক্তকে দায়মুক্তি সনদ দিচ্ছে দুদক। ২০১৪ এর জানুয়ারি থেকে আগষ্ট পর্যন্ত দুর্নীতির অভিযোগ থেকে অব্যাহতি পাওয়াদের মধ্যে রয়েছেন জাতীয় সংসদের উপনেতা ও সাবেক বনমন্ত্রী সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী,স্বাস্থ্য মন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম, মন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া,প্রধানমন্ত্রীর সাবেক স্বাস্থ্য উপদেষ্টা সৈয়দ মোদাচ্ছের আলী, সাবেক এমপি এইচবিএম ইকবাল সহ বিভিন্ন পর্যায়ের সরকারি বেসরকারি কর্মকর্তাবৃন্দ। তাছাড়া, স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর, সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তর, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডসহ (এনবিআর) সহ সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ১১টি প্রতিষ্ঠানে অনুসন্ধান শুরু হলেও এসব তদন্তের বাস্তব কোন ফলাফল জনগণ দেখতে পায়নি। প্লট বরাদ্দে অনিয়মসহ শত শত কোটি টাকার দুর্নীতির অভিযোগে সচিব ড. খোন্দকার শওকত হোসেনের বিরুদ্ধে করা ৩টি মামলা থেকেই অব্যাহতির সুপারিশ করে দুদকে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছেন তদন্তকারী কর্মকর্তা। অবৈধ সম্পদের অভিযোগ থেকে আগেই রেহাই দেওয়া হয়েছে পুলিশের সাবেক আইজি এবং বর্তমান যুব ও ক্রীড়া সচিব নূর মোহাম্মদকে। দীর্ঘ এ ফিরিস্তি এখানেই শেষ নয়।
হলমার্ক সহ হাজার হাজার কোটি টাকার দুর্নীতির সাথে সংশ্লিষ্ট থাকা সত্ত্বেও আড়াই বছরেও শেষ হয়নি অবৈধ সম্পদের অনুসন্ধান। এমনকি অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও সোনালী ব্যাংকের এমডি ও সিইও প্রদীপ কুমার দত্তের বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগটি নথিভুক্ত করে দুর্নীতির দায় থেকে রেহাই দিয়েছে দুদক। ২০১৪ সালের মে মাসে মুক্তিযুদ্ধের সম্মাননা ক্রেস্টে স্বর্ণ জালিয়াতির ঘটনার অনুসন্ধানে জালিয়াতির সব ধরনের নথি পাওয়া গেলেও অভিযোগের অনুসন্ধান এখন হিমাগারে। এমনকি রেলের নিয়োগ দুর্নীতিতে মূল অভিযুক্ত ব্যক্তি পর্দার অন্তরাল থেকে অবৈধ প্রভাব বিস্তারের মাধ্যমে দুর্নীতির প্রধান সহযোগী রেলওয়ের মহাব্যবস্থাপক ইউসুফ আলী মৃধাকে দুদকের করা পাঁচটি মামলা থেকে অব্যাহতি পান। ২০১৩ সালের জানুয়ারিতে ৩০৬ মডেল স্কুল প্রকল্প বাস্তÍবায়নে অনিয়ম-দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযোগের অনুসন্ধান প্রতিবেদন এখনো তৈরি হয়নি। পেট্রোবাংলায় নিয়োগসহ অন্যান্য দুর্নীতির অভিযোগে সংস্থার সাবেক চেয়ারম্যান ড. হোসেন মনসুরসহ অন্যদের বিরুদ্ধে মামলার সুপারিশ করলেও অনুসন্ধান প্রতিবেদন পেশ করার পরও দুদক অভিযোগটি পুনরায় অনুসন্ধানের নির্দেশ দিয়ে বাস্তবে অভিযোগটি ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা চলছে অবৈধ সম্পদ অর্জন এবং সম্পদের তথ্য গোপনের অভিযোগে দুদকের দায়ের করা দুর্নীতি মামলায় গ্রেপ্তার আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য আব্দুর রহমান বদি বীরদর্পে দুদকের বিরুদ্ধে হুমকি দিচ্ছে।
উল্লেখ্য, গত প্রায় ৪ বছরে দুদক বিলুপ্ত দুর্নীতি ব্যুরোসহ সর্বমোট ৫,৩৪৯টি দুর্নীতির অনুসন্ধান নথিভুক্ত করে আসামিদের দায়মুক্তি দিয়েছে। শুধুমাত্র ২০১৪ সালের আগস্ট মাস পর্যন্ত প্রায় ১,৬০০ রাজনৈতিক ব্যক্তি ও উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তাদের দুর্নীতির অভিযোগ থেকে দায়মুক্তি দেয়া হয়েছে। এ সময়ের মধ্যে দুদক ৯০৪টি দুর্নীতির অভিযোগের মধ্যে ৮৭০ জনের বিরুদ্ধে কোনো মামলাও দায়ের করেনি। ৩০৭টি মামলা নথিভুক্ত করে ৭১৮ জন আসামির বিরুদ্ধে 'দুর্নীতির প্রমাণ না পাওয়া'র অজুহাতে তাদেরকে দায়মুক্তি দিয়ে চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দিয়ে গোপনে 'সততার সনদ' দিয়েছে দুদক। মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন (এফআরটি) তে বলা হয়, 'মামলা দায়েরের যথার্থতা না থাকা,তদন্তে পর্যাপ্ত তথ্য এবং সাক্ষী না পাওয়ায় মামলাটি চূড়ান্ত প্রতিবেদনের মাধ্যমে নথিভুক্ত করেছে কমিশন'। দুদক দুর্নীতির কিনারা তো করেইনি বিভিন্ন দুর্নীতির ব্যাপারে যতখানি লোক দেখানো পদক্ষেপ নিয়েছে তাও মিডিয়ার চাপে পড়ে করেছে।
সরকারি দলের লোকজন বিনা বাধায় টেন্ডারবাজি, শেয়ার বাজার ও ডেসটিনি ছাড়াও হলমার্কসহ বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে প্রায় সব সরকারি-বেসরকারি ব্যাংক সহ খাল-বিল, নদী-নালা এবং রাষ্ট্রের জমি,সম্পদ লুটপাট করছে। এমনকি বিনা ভোটের সংসদ সদস্যরা প্রকাশ্যে দিবালোকে ক্রেস্টের মাধ্যমে সম্মাননা নয়, ক্যাশ চাইলেও তারা বহাল তবিয়তে। শুধু তাই নয়, সরকারের একাধিক মন্ত্রীর অর্থাৎ সরকারের সাথে প্রকাশ্য ব্যবসা থাকার অকাট্য প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও তারা মন্ত্রী হিসাবে বহাল আছেন। জাতীয় বাজেটের মাধ্যমে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ অব্যাহত রয়েছে।।