সুদাম শিরোলে। বয়স ৩০ কি ৩৫। গত কয়েক মাস কলকাতার অতিথি। অনাকাঙ্খিত অতিথি। ভবঘুরে, মানসিকভাবে ভারসাম্যহীন।তার ওপরে দেহাতি তার ভাষা। আতিথেয়তা তাই বড় বালাই। আস্তানা বাঘাযতিন স্টেশনের অদূরে বাইপাসের ব্রিজটায়। সারাটাদিন আশপাশটায় ঘুরে বেড়ায়, অনতিদূরে ট্যাঙ্কের ঝরা জলে চান করে, কাছের দোকানগুলোতে কেউ খেতে দিলে খায়। কেউ কেউ হাতে দুচার টাকা দেয় বলেই না খেতে পেয়ে মরে যায়নি।
আমাদের এ শহরেরই এক বন্ধু অরোত্তম সেই গুটিকয় মানুষের একজন। সুদামের দেহাতি ভাষা বুঝত না। না জানত নাম, না জানত বাড়ি। পুলিশকে বারবার জানিয়েও ছিল সে। সদুত্তর মেলেনি। সদুত্তর মেলে না। পেট্রোলিং পুলিশ জিপ থামিয়ে 'পাগল'টাকে দেখিয়েছিল, বলেছিল ভিন রাজ্যের, খুঁজে বের করুন। কেটে গেল কয়েকটা মাস।
বাকি গল্পটা খুব ছোট। মাত্র দুদিনের। আর পরিশ্রম মেরে কেটে ৪ ঘণ্টারও হবে কিনা সন্দেহ। তার বিড়বিড়ানি কথার রেকর্ড করতে গিয়ে বোঝা যায় মহারাষ্ট্রের জামখেড় জেলায় বাড়ি তার। কোন একটা ট্রাইব। সে পরিষ্কার নিজের নাম, গ্রামের নাম জানায়। এমনকি সে তার পরিবারকে দোষ দিতে থাকে তাকে আমাদের ভাষা শেখায়নি বলে আমাদের ভাষা সে বুঝতে পারছে না। সে কিভাবে তার বাড়ি যাবে তা জানে না। একমাত্র তার বাড়ির লোক এসে তাকে নিয়ে গেলেই সে ফিরতে পারবে। আরও অনেক কিছু বলে, কিন্তু তার দেহাতি ভাষা আপনার-আমার মর্মোদ্ধারের অতীত।
নেটে নানান জায়গায় অডিওটি মেল করার পর জামখেড়ের একটা সংস্থা উদ্যোগ নিয়ে কথাগুলোর অণুবাদ পাঠায়। ছেলেটির ছবি আর বাবার নামের সূত্র ধরে তারাই ছেলেটির পরিবারকে খুঁজে বের করে কোদা-অস্তি গ্রাম থেকে। আজ সকালে তার বাড়ির লোক তাকে নিয়ে কলকাতা থেকে রওনা দিয়েছে। অনেকদিন পর ঘরের ছেলে ঘরে ফিরছে।
কাজটা ছোট কাজই ছিল। অরোত্তম সহনাগরিকের ভূমিকাই পালন করেছে শুধু। যদিও এইটুকু পালন করার লোকটাই আজ সবচেয়ে দুর্লভ। প্রশাসন করবে মনে করলে করে ফেলতে পারত নিশ্চয়ই। খোদ কলকাতার পুলিশই.........। না হয় বুঝি রাজনৈতিক দলাশ্রিত রাজনৈতিক দুষ্কৃতিকে খুঁজে না পাওয়ার নাটক চলছে। তাও না। গত দুদিনের তৎপরতার মাঝেও পুলিশের সাহায্য চাওয়া হয়। হায় রে! নিচু তলার এক সহৃদয় পুলিশ আলাদা করে ডেকে জানালো যা করছেন ভালো কাজ করছেন, খামোকা পুলিশকে জানানোর দরকার নেই, ফালতু আপনিই ফেঁসে যাবেন। । কোরপানের সুবিচার না পাওয়ার কারণের সাথে এর ভাগ্যও একই সুতোয় বাধা। শাসকের অঙ্গুলি হেলনে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ঢুকে সুনিপুণভাবে ছাত্রিছাত্র পেটাতে পারা যায়, এহেন একাজে সময় কই? একটা উদ্যমী ছেলের চোখে পড়ে গিয়েছিল, না হলে হাজারো নিরুদ্দেশের মতো এ-শহরের ভিড়ে সুদাম হারিয়ে যেত। কেউ জানতেও পারত না।
'এই কয়েক ঘণ্টার অভিজ্ঞতায়'আমার বন্ধুটি নিশ্চয়ই 'সংসারে একেবারে বুড়া'হয়ে পড়েছে।