৪০ বছর পরও বাসন্তীরা বাসন্তীই রয়ে গেছে
১৯৭৪ সালের কথা। দেশজুড়ে তখন করাল দুর্ভিক্ষ। দৈনিক ইত্তেফাকে প্রকাশিত একটি ছবি বিশ্বময় ঝড় তুলেছিলো। সেসময়ের ক্ষমতাসীন সরকারের তখতে তাউস নাড়িয়ে দিয়েছিলো। ছবির নায়িকা কুড়িগ্রামের চিলমারীর বাসন্তী। ১৯৭৪ সালে দুর্ভিক্ষের সংবাদ সংগ্রহ করতে দৈনিক ইত্তেফাকের রিপোর্টার শফিকুল কবির আর আলোকচিত্রী আফতাব আহমেদ গিয়েছিলেন কুড়িগ্রামে। এমনিতেই এঅঞ্চলের মানুষ মঙ্গাপিড়ীত থাকে বছরের বেশ খানিকটা সময়। তার উপরে '৭৪-এর ভয়াবহ মনান্তর। ক্ষুধার জ্বালায় দিশেহারা মানুষ খড়-কুটা থেকে শুরু করে যা পেয়েছে তাই খেয়ে ক্ষুন্নবিৃত্তি করেছে।
মাছধরার জাল পড়া সেই বাসন্তী পাশে তার বোন দূর্গতী
সাংবাদিক শফিকুল কবীর আর আফতাব আহমেদ দুর্ভিক্ষে অসহায় মানুষের সংবাদ সংগ্রহ করতে করতে পৌঁছান চিলমারী বাজারের অদূরে মাঝিপাড়ায় বাসন্তীদের বাড়ীতে। দূর্ভিক্ষের পাশাপাশি ভয়াল বন্যায় বাসন্তিদের তখন চরম দুর্বিসহ দিন কাটছে। এখানেই বাসন্তী আর তার চাচাতো বোন দুর্গতি'র ছবি তোলেন আফতাব আহমেদ। এই ছবিতে দেখা যায় খাবারের জন্য বাসন্তি আর দুর্গতি কলাগাছের পাতার গোড়ার অংশ সংগ্রহ করছে। পরনের ছেঁড়া শাড়ীর সাথে ছেঁড়া জাল গায়ে জড়িয়ে তারা সম্ভ্রম রক্ষার চেষ্টা করছে।
ছবিটি দৈনিক ইত্তেফাকের প্রথম পৃষ্ঠায় গুরুত্ব দিয়ে ছাপা হয়। এই ছবি ছাপা হবার পর হৈ-চৈ পড়ে যায়। তৎকালীন আওয়ামী সরকারের ভাবমূর্তি প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে বিশ্বময়। বাসন্তী'র সেই ছবি হয়ে ওঠে চুয়াত্তরে বাংলাদেশের দুর্ভিক্ষের 'ব্রান্ড এ্যাম্বাসেডর'।
এই ছবি প্রকাশের অন্তত: একযুগ পরে এই ছবির সত্যাসত্য নিয়ে প্রশ্ন তোলেন কেউ কেউ। বলা হয়- অপুষ্ট, বুদ্ধি এবং বাক প্রতিবন্ধী কিশোরী বাসন্তীর 'ফটোসেশন'করতে তাকে নগদ পঞ্চাশ টাকা দেয়া হলে বাসন্তী ছবি তুলতে রাজী হয়। সাংবাদিক শফিকুল কবীর আর আফতাব আহমেদকে সংবাদ সংগ্রহে সহায়তাকারী সেসময়ের চিলমারীর অস্থায়ী চেয়ারম্যান আনছার আলী একটি ছেঁড়া জাল পরিয়ে বাসন্তী এবং দুর্গতিকে কলাগাছের পাতা কাটতে বললে তারা তা করতে থাকে। আর তাদের সেই কাজের ছবি তোলেন আফতাব আহমেদ। এই ছবির তীব্র সমালোচনা করে অনেক বুদ্ধিজীবী একে তৎকালীন সরকারকে অস্থিতিশীল করা এবং শেখ মুজিব হত্যা ষড়যন্ত্রের সাথে ধারাবাহিক যোগসূত্রের কথাও বলেন।
৪০ বছর পর
আমরা গিয়েছিলাম চিলমারীতে। ভাওয়াইয়া গানের সম্রাট শিল্পী আব্বাসউদ্দীনের অমর গান- 'ওকি গাড়িয়াল ভাই--- হাঁকাও গাড়ী তুমি চিলমারী বন্দরে--'ক্ষ্যাত চিলমারী বন্দরের বর্তমান অবস্থা জানতে। একমসয় এই চিলমারী খুবই জমজমাট এবং প্রসিদ্ধ বন্দর ছিলো। এখানে বড় বড় জাহাজ-কার্গো ভিড়তো। এসব নৌযান মানুষ ও পণ্য পরিবহন করে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রাম এমনকি দিল্লী কিংবা কোলকাতায়ও যেত। এখন সেসব দিন সুদূর পরাহত। দেশ বিভক্তির পর আস্তে আস্তে তা বন্ধ হয়ে গেছে। সাধারণ এবং বয়েসী মানুষ আমাদেরকে সেসব কথাই বলছিলেন।
কথায় কথায় উঠে আসে বাসন্তীর নাম। আমাদের আগ্রহ বেড়ে ওঠে বাসন্তীকে দেখার। চিলমারী বাজার থেকে দু-তিন'মিনিটের পথ বাসন্তীদের মাঝিপাড়া। কেউ কেউ একে বাসন্তীগ্রামও বলে। আমি ভেবেছিলাম বাসন্তীর সেই ছবি'র ব্যাপারে তার কাছ থেকেই সত্যাসত্য জেনে নেব। কারণ আমি আসলে জানতামই না বাসন্তী বুদ্ধি এবং বাক প্রতিবন্ধী। উৎসাহী মানুষরা যখন আমাদেরকে বাসন্তীর ঘরের সামনে নিয়ে এলো আমরা খুব হতাশ হলাম। বাসন্তী অস্ফুট স্বরে কি যেনো বললো ঠিক বোঝা গেল না। বার বার তার তার শীর্ণ পা দেখিয়ে আমাদেরকে যা বোঝাতে চাইলো, তাতে আমরা বুঝলাম তার পায়ে ব্যথার ব্যাপারটি। তার কাছে যা-ই জিজ্ঞেস করি ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকা কিংবা অষ্ফূট আর্তনাদের মতো কিছু শব্দ ছাড়া তার কাছ থেকে পরিস্কার কিছু পাওয়া গেলো না। স্বজনদের মধ্যে তার এক ভাই আছে সে-ও ঢাকা গেছে। ভাইয়ের স্ত্রীও ভালো কোনো তথ্য দিতে পারলো না। শেষমেষ প্রতিবেশীদের কয়েকজনকে জিজ্ঞেস করে মিশ্র একটা ধারণা পেলাম আমরা।
বাসন্তীরা ক'দিন আগেও যমুনার ভাঙ্গনে নদী-শিকস্তি হয়ে নদীর পাড়ের একটি বাঁধের পাশে ছাপড়া তুলে আশ্রয় নিয়েছে। মাঝিপাড়ার প্রায় শ'খানেক পরিবার আছে সেখানে। বাসন্তী এখনো অনাহারে অর্ধাহারে কাটায়। সবাই তাকে বাসন্তী পাগলী বলে।
বাসন্তী'র ছবি প্রকাশের পর কেটে গেছে দীর্ঘ ৪০ বছর। প্রমত্ত যমুনায় বয়ে গেছে কোটি কোটি কিউসেক পানি। অসংখ্য চর যেমন জেগেছে- পানির তোড়ে বিলীন হয়েও গেছে অনেক জনপদ। একসময়ের জমজমাট চিলমারী বন্দর বয়সে ভারাক্রান্ত বাসন্তীর মতো যবুথবু হয়ে গেছে। দেশে সরকার প্রধান বদল হয়েছে অনেক। রাজনৈতিক উত্থান-পতনের মাঝে নিত্য উন্নয়নের গালগল্প শুনতে শুনতে আমরা পুলকিত, উজ্জীবিত অথবা হতাশ হয়েছি অনেকবার। কিন্তু বাসন্তীদের ভাগ্যে পরিবর্তন আসেনি। বাসন্তীরা বাসন্তীই রয়ে গেছে।