মেয়েদের মাথার চুল থেকে পায়ের নখ পর্যন্ত কালো পর্দায় ঢেকেও শান্তি হচ্ছে না সৌদি আরবের। এখন থেকে মেয়েদের চোখও, বিশেষ করে যে চোখগুলো সুন্দর, ঢেকে রাখতে হবে। চোখ ঢাকলে মেয়েরা দেখবে কী করে! তাদের দেখার দরকার নেই। মেয়েদের দেখাটা জরুরি নয়। তারা অন্ধ হয়ে যাক। তারা খানা খন্দে পড়ুক, মরুক। অনাত্মীয় পুরুষেরা যেন মেয়েদের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ না দেখে। মেয়েরা কোনও না কোনও পুরুষের সম্পত্তি। অন্যের সম্পত্তির দিকে তাকানোটা আর যেখানেই চলুক, সৌদি আরবে চলবে না।
মেয়েদের আকর্ষণীয় চোখের দিকে যদি চোখ পড়ে বাইরের পুরুষের, তবে কে হলফ করে বলতে পারে, সেই পুরুষ কামোত্তেজনায় কাতরাবে না, ধর্ষণের চেষ্টা করবে না! পুরুষেরা ধর্ষণের চেষ্টা করবে ধরে নিয়েই মেয়েদের প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে মেয়েদের। এরকম মনে করার কিন্তু কোনও কারণ নেই যে মেয়েদের স্বার্থে মেয়েদের ধর্ষণ থেকে বাঁচানো হচ্ছে। মেয়েরা যেহেতু কোনও না কোনও পুরুষের সম্পত্তি, অথবা হবু সম্পত্তি, তাই পুরুষের স্বার্থেই পুরুষের সম্পত্তিকে ধর্ষণ থেকে বাঁচানো হচ্ছে। পুরুষেরা চায় না তাদের সম্পত্তির গায়ে কোনও দাগ লাগুক। এ কারণে শরীর তো বটেই, মেয়েদের চোখও ঢেকে রাখার ব্যবস্থা হচ্ছে। তাদের কোনও কিছু দেখার অধিকার আর নেই। চোখ থাকতেও অন্ধত্বকে বরণ করে নিতে তারা বাধ্য হচ্ছে।
অথচ, অবাক কাণ্ড, ধর্ষণের চেষ্টা যারা করবে বলে আশংকা করা হচ্ছে, তাদের দমনের, তাদের শোধরানোর, তাদের পরামর্শ দেওয়ার কিন্তু কোনও ব্যবস্থা সৌদি আরবে নেই।
আমার প্রশ্ন, পুরুষেরা কামোত্তেজনায় কাতরালেই বা অসুবিধে কী! উত্তেজনা সামলানোর ক্ষমতা কি সৌদি পুরুষের নেই? যদি না থাকে, তবে ওদের শেখানো হোক কী করে তা সামলাতে হয়। শিখলে মেয়েরা অন্তত চোখ খুলে রাস্তাঘাটে চলাফেরা করতে পারবে। খানা খন্দে পড়তে হবে না, মরতে হবে না। নীতিপুলিশের জ্বালায় মেয়েরা বাধ্য হচ্ছে আস্ত এক একটা কালো কফিনের মধ্যে ঢুকে যেতে। চোখগুলোকেও এখন থেকে বোরখা পরাতে হবে নয়তো জেল খাটতে হবে। নীতিপুলিশকে পুষছে কিন্তু সৌদির রাজ পরিবার। এই ক'মাস আগেই নাকি নীতিপুলিশদের সংস্থা রাজপরিবার থেকে তিপ্পান্ন মিলিয়ন ডলার উপহার পেয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্র কি কখনও সৌদি আরবের মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে কথা বলেছে? কেউ শুনিনি। সৌদি আরবের কাছে যুক্তরাষ্ট্র এখন অস্ত্র বিক্রি করছে। ষাট বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র। ছোটখাটো কোনও অংক নয় কিন্তু। তো এই সময় যুক্তরাষ্ট্র সৌদি আরবকে কি পারতো না বলতে যে তোমরা মেয়েদের ওপর অত্যাচার বন্ধ করো, তারপর অস্ত্রের বেচা কেনা হবে? সৌদি আরবের মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র মুখ খোলে না, কিন্তু নানা দেশের মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে ভীষণই উদ্বিগ্ন, চেঁচিয়ে সর্বনাশ করছে, সাবধান করে দিচ্ছে পৃথিবীর অনেক দেশকেই। শুধু সেই দেশটিকেই সাবধান করছে না, যে দেশটি মেয়েদের মানবাধিকার সবচেয়ে বেশি লংঘন করছে। এর একটিই হয়তো কারণ, এমন বিলিয়ন ডলারের খদ্দেরকে যুক্তরাষ্ট্র অখুশি করতে চায় না। দিনের শেষে টাকার হিসেবটাই দেখছি আসল হিসেব।
সৌদি আরব মেয়েদের মানুষ বলে মনে করে না। ধর্ষিতা হওয়ার শাস্তি ধর্ষিতাকেই দেয়। আত্মীয়-পুরুষ ছাড়া অন্য কোনও পুরুষের সঙ্গে কোনও মেয়ের কথা বলা, চলা ফেরা বারণ। স্বামীর অনুমতি ছাড়া মেয়েদের ঘরের চৌকাঠ পেরোনোও নিষেধ। বৈষম্যের সহস্র শৃংখলে বন্দি নারী। নারী হয়ে জন্ম নিয়েছে বলেই ভুগতে হচ্ছে বর্বর পুরুষের এই পৃথিবীতে। ধর্ম আর পুরুষতন্ত্রের শাসন সৌদি আরবে। পুরুষেরই দাপট সে দেশে। সুতরাং যদি আদৌ কারোর ক্ষমতা থাকে সৌদি মেয়েদের দুর্দশা দূর করার, পরাধীনতার গহ্বর থেকে তাদের উদ্ধার করার, সে নিঃসন্দেহে সৌদি পুরুষের। মেয়েদের বিরুদ্ধে সৌদি আইনের প্রতিবাদ করতে এ পর্যন্ত খুব বেশি সৌদি পুরুষকে অবশ্য দেখা যায়নি।
মন্দ কাজ বন্ধ করার একটা কমিটি আছে সৌদি আরবে, সেই কমিটির লোকেরাই বলেছে তারা মেয়েদের হাতছানি দেওয়া চোখ নিষিদ্ধ করেছে। কোন চোখ হাতছানি দেয়, কী করে বুঝবো! যে চোখে কাজল, সেই চোখ তো বটেই, তার ওপর চোখের আকার আকৃতি ভালো, এমন চোখও পাপের চোখ, হাতছানির চোখ। চোখ সুন্দর হলেও কোনও ক্ষমা নেই, সে চোখ নিষিদ্ধ। আর যে চোখে কাজল নেই! কাজল না থাকলেও সে চোখ নিষিদ্ধ হতে পারে, শুধু দেখতে ভালো হওয়ার অপরাধে।
মেয়েদের বিরুদ্ধে এই আইনটিকে ইতিমধ্যে একশ ভাগ সমর্থন করেছেন সৌদি রাজপুত্র নাইফ। এই আইনটি এমনই এক বর্বর নারীবিরোধী আইন, এই আইনে যে-কোনও মেয়েকে যখন তখন দোষী সাব্যস্ত করা যায়, জেলে পাঠানো যায়, চাবুক মারা যায়। যেন এ মেয়েদের অপরাধ তারা মেয়ে। যেন এ মেয়েদের অপরাধ তাদের চুল চোখ মুখ আছে, যেন এ তাদের অপরাধ তাদের বুক পেট তলপেট আছে, তাদের পা আছে, পায়ের পাতা আছে। যেন মেয়েরা মানুষ নয়, মেয়েরা এক শরীর পাপ। এই পাপকে, এই লজ্জাকে ঢেকেঢুকে অপরাধীর মতো বাঁচতে হবে, যদি বাঁচতেই হয়। কমিটির লোকেরা দুনিয়ার মুসলিমদের কাছে আবেদন করেছেন, নতুন আইনটিকে সকলেই যেন সমর্থন করে, যেহেতু এই আইন ইসলামের আইন। ইসলামের প্রশ্নে দ্বিমত করে, সাধ্য কার!
'যৌন উত্তেজনা বেড়েছে তোমার, সে তোমার সমস্যা, আমার নয়। তোমার সেটি বাড়ে বলে আমার নাক চোখ মুখ সব বন্ধ করে দেবে, এ হতে পারে না। আমি তোমার ব্যক্তগত সম্পত্তি নই যে তুমি আমাকে আদেশ দেবে আমি কী পরবো, কীভাবে পরবো, কোথায় যাবো, কতদূর যাবো। তোমার সমস্যার সমাধান তুমি করো। আমাকে তার দায় নিতে হবে কেন! যৌন উত্তেজনা আমারও আছে, সে কারণে তোমার নাক চোখ মুখ ঢেকে রাখার দাবি আমি করিনি। আমার ইচ্ছে হলে আমি চোখে কাজল পরবো, কাজল কালো চোখ দেখলে যদি তোমার সমস্যা হয়, তাহলে আমারে চোখের দিকে তাকিও না। যদি তারপরও চোখ চলে যায় মেয়েদের চোখের দিকে, আর তোমার ঈমানদণ্ড নিয়ে তুমি বিষম মুশকিলে পরো, তাহলে শক্ত করে নিজের চোখদুটো বেঁধে রাখো কালো কাপড় দিয়ে। এর চেয়ে ভালো সমাধান আর হয় না। তোমাকে উত্তেজিত করে এমন জিনিস তোমাকে দেখতে হবেনা। তুমিও বাঁচবে, আমিও বাঁচবো।' --- জানিনা সৌদি মেয়েরা কবে বলবে এমন কথা।
আজ সারা বিশ্ব হাসছে সৌদি আরবের কাণ্ড দেখে। নামতে নামতে তারা কত নিচে নেমেছে! মেয়েদের সর্বাঙ্গ নিষিদ্ধ করেছে, এমনকী চোখও। এত ঘৃণা করে ওরা মেয়েদের! বুঝিনা সব মেয়েকে কেন আজও তারা মেরে ফেলছে না! কেন জ্যান্ত কবর দিচ্ছে না, কেন দূর করে দিচ্ছে না দেশ থেকে! কেন এত ঘৃণার পরও মেয়েদের বাঁচিয়ে রাখছে। সম্ভবত বাঁচিয়ে রাখছে একটিই কারণে, পুরুষেরা যেন ওদের ভোগ করতে পারে, সম্পত্তির ওপর অধিকার আছে তো মালিকের।