এক. পদ্মা সেতুর দুর্নীতির অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দিয়ে অভিযুক্ত সবাইকে 'ক্লিন সার্টিফিকেট' দিয়েছে দুদক। ২০ মাসের দীর্ঘ তদন্তে দুদক নাকি কিছুই খুঁজে পায়নি। এদিকে অক্টোবরের ৮ তারিখে দুদক থেকে দায়মুক্তির সার্টিফিকেট পেয়ে যান সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী রুহুল হক। সরকারদলীয় আরেক সংসদ সদস্য আসলামুল হকও পান একইরকম দায়মুক্তির সনদ। রেলের কালো বিড়ালরাও অনেক আগেই দুদক থেকে দায়মুক্ত। সর্বশেষ রেলের জিএম ইউসুফ আলী মৃধাও দুদকের পাঁচ মামলা থেকে অব্যাহতি পেয়েছেন। এ যেন অদ্ভুত এক 'দায়মুক্তির কমিশন'! যেখানে শেয়ার কেলেঙ্কারির নায়করা দুদকের ধরাছোঁয়ার বাইরেই থাকে। সোনালী ব্যাংকের 'রাজনৈতিক পরিচালক' সুভাষ সিংহ রায় আর জান্নাত আরা হেনরীদের এখন আর পালিয়ে থাকতে হয় না। দায়মুক্তির সনদ পাওয়া যত সহজ, মুক্তিযুদ্ধের ভুয়া সনদও এখানে ততই সস্তা। মুক্তিযুদ্ধের ভুয়া সনদধারী চার সচিবের দুর্নীতিতে দুদকের যেন কিছুই করার নেই। কাগজে-কলমে দুদক স্বাধীন হলেও বাস্তবে এ কাগুজে বাঘের করুণ পরাধীনতার গল্প আজ মানুষের মুখে মুখে।
দুই. এবার পত্রিকার খবর পড়ে একটু আশ্চর্যান্বিতই হলাম! গত ৩০ অক্টোবর সরকারি প্রতিষ্ঠান সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি দুদকের বিরুদ্ধে চরম ক্ষোভ প্রকাশ করেছে। কারণ হলো, বেসিক ব্যাংকের অর্থ আত্দসাৎকারীদের বিষয়ে দুদক নাকি ইচ্ছাকৃতভাবে নিষ্ক্রিয় রয়েছে। জালিয়াতকারীরা নাকি বেসিক ব্যাংকের টাকা বস্তায় ভরে নিয়ে গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক তথ্য-প্রমাণ দিয়ে দুদককে নথি পাঠালেও দুদক কোনো পাত্তাই নাকি দিচ্ছে না। এ নিয়ে সংসদীয় কমিটির সভাপতি শওকত আলী জানান, জালিয়াতরা সাড়ে চার হাজার কোটি টাকার বেশি আত্দসাৎ করেছে। তারা দুদককে নথি পাঠালেও দুদক কোনো কর্ণপাত করেনি। দুদকের এ কর্মকাণ্ডে বাংলাদেশ ব্যাংকও হতাশ। বেসিক ব্যাংকের পরিচালনা পরিষদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে দুদক অযথা কেন মাথা ঘামাবে, যেখানে স্বয়ং অর্থমন্ত্রীই চার হাজার কোটি টাকাকে কোনো টাকাই মনে করেন না বলে প্রকাশ্যে ঘোষণা দেন।
তিন. ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর দুদক জনমনে কিছুটা হলেও আশার সঞ্চার করেছিল। নির্বাচনের ঠিক ১০ দিনের মাথায় হঠাৎ করেই দুদক সক্রিয় হয়ে ওঠে। সরকারের নয়জন মন্ত্রী-এমপির বিপুল পরিমাণ সম্পদের অনুসন্ধানের ঘোষণা দেয়। কিন্তু ধীরে ধীরে দুদক তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার বদলে দায়মুক্তির সার্টিফিকেট দেওয়া শুরু করে। দুদকের দাবি, তারা এসব মন্ত্রী-এমপির হলফনামায় দেওয়া তথ্যের কোনো সত্যতাই খুঁজে পায়নি। অথচ হলফনামায় দেওয়া তথ্য স্বয়ং ব্যক্তির নিজের হাতেই দেওয়া তথ্য। তারপরও দুদক এটাকে প্রমাণ করতে পারল না কেন? দুর্নীতিবাজদের শাস্তির বদলে পুরস্কার দিল দুদক। দুদক যেন দাগ-ময়লা পরিষ্কার করার একটা অত্যাধুনিক প্রযুক্তি!
চার. ইতিমধ্যে পদ্মা সেতুর দুর্নীতি মামলার সবাইকে সসম্মানে খালাস দেওয়া হয়েছে। সরকারের সাবেক দুই মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী ও সরকারদলীয় হুইপের ভাইকে বাদ দিয়েই তখন মামলাটা করা হয়েছিল। যদিও সচিবসহ তিন সরকারি কর্মকর্তা মামলায় অভিযুক্ত হলেও সেই মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী তার কিছুই জানতেন না বলে জানানো হয়েছিল। ২০১২ সালের ৩০ জুন দুর্নীতির 'বিশ্বাসযোগ্য' প্রমাণ মিলেছে জানিয়ে চুক্তি বাতিল করে বিশ্বব্যাংক। ওই বছরের ডিসেম্বরে সাতজনের বিরুদ্ধে মামলা করে দুদক। গত ৩ সেপ্টেম্বর কোনো প্রমাণ পায়নি বলে দুদক সবাইকে দায়মুক্তি প্রদান করে। আগামী বছরের ১৩ এপ্রিল কানাডার আদালতে এ মামলার আনুষ্ঠানিক বিচার শুরু হচ্ছে।
এদিকে এ মামলার শেষ না দেখেই দ্রুত তদন্তের সমাপ্তি ঘোষণা করল দুদক। দুদক অবশ্য এর সব দায় চাপাল বিশ্বব্যাংক ও কানাডা পুলিশের ঘাড়ে। দুদক বলছে, তারা কোনো তথ্য-প্রমাণ দুদককে দেয়ইনি। যদিও এ বিষয়ে বেশ কিছু ই-মেইল বার্তা দিয়ে দুদককে সব দুর্নীতির বিবরণ দিয়েছিল বিশ্বব্যাংক। এসব তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতেই যেখানে কানাডায় মামলা হলো, সেখানে আমাদের দুদক নাকি কিছুই খুঁজে পেল না! মনে থাকার কথা, কানাডার প্রাক-বিচার শুনানিতে বাংলাদেশের একাধিক রাজনীতিবিদ জবানবন্দি দিয়ে এসেছেন। তারা সেখানে গিয়ে অনেক কিছুই বলে এসেছেন। দুদক তাদের একটু জিজ্ঞাসাবাদ করলে অনেক তথ্যই পেয়ে যেত।
পাঁচ. এর আগে রমেশের ডায়েরিকে 'বাজারের ফর্দের' সঙ্গে তুলনা করেছিল দুদক। সুরঞ্জিতের এপিএসের গাড়ি চালকের পেশা ও সামাজিক মর্যাদা নিয়ে তার সাক্ষ্যকে অগ্রহণযোগ্য বলেছিল তারা। দুদকের তদন্তে বিশ্বব্যাংক অসন্তুষ্ট হয়ে চিঠি দেওয়ার পরও দুদক বলেছিল, 'দুদকের তদন্তে বিশ্বব্যাংক খুশি'। বিশ্বব্যাংকও তৎক্ষণাৎ চিঠিটি গণমাধ্যমে প্রকাশ করে। এই চিঠি এখনো তাদের ওয়েবসাইটে আছে। দুদক শুধু সত্য আড়ালের চেষ্টাই করেনি, বরং তার রাজনৈতিক চরিত্রের প্রকাশও ঘটাতে আমরা দেখেছি। যে কারণে বিশ্বব্যাংকের তদন্ত দলকে তারা বলেছিল, 'মন্ত্রীর বিরুদ্ধে মামলা হলে রাজনৈতিক সমস্যা বা হট্টগোল দেখা দেবে'। জবাবে বিশ্বব্যাংকের গ্যাব্রিয়েল মোরেলো ওকাম্পো লিখেছিলেন, 'যে রাজনৈতিক পরিচয়ই হোক না কেন, তাকে ছাড় দেওয়া হলে তদন্তকে মোটেই স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ বলা যাবে না'। দুদকের বিরুদ্ধে কিছু বলতে গিয়ে হুমকিও পেতে হয়েছে সুধীজনের। গত ২৮ মে দুদক টিআইবিকে হুমকি দিয়ে বলে, 'সময় হলে টিআইবির মুখোশ উম্মোচন করা হবে'।
ছয়. আসলে দুদকের ২০১৩ সালের হয়রানিমূলক সংশোধিত আইনেই রয়েছে ক্ষমতার অপব্যবহারের যতসব কলাকৌশল। আইনি দুর্বলতার কারণে একদিকে প্রভাবশালীরা অব্যাহতি পাচ্ছেন, আরেকদিকে বিরোধীদের মামলা দিয়ে হয়রানি করা হচ্ছে। আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে দুর্নীতিবাজদের বের করে আনার পথঘাট সবই অসাধু কর্মকর্তারা বাতলে দিচ্ছেন। সংশোধিত দুদক আইন ২০১৩-এর ২২ ধারায় কমিশন অভিযুক্তের বক্তব্য শুনে সন্তুষ্ট হয়ে তাকে অব্যাহতি দিতে পারে। সেক্ষেত্রে ওই ব্যক্তির অভিযোগ নথিভুক্ত করা বা চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিলেও কারও কিছু বলার নেই। তাই এ বিধানের সুযোগ নিয়ে কোনো ধরনের ব্যাখ্যা বা জবাবদিহি ছাড়াই দুদক প্রভাবশালীদের গণহারে দায়মুক্তির সার্টিফিকেট দিয়ে দিচ্ছে। অন্যদিকে এ আইনের ১৯(১)(ক) ধারায় শপথের মাধ্যমে সাক্ষীকে জিজ্ঞাসাবাদের বিধান সংশোধন করে 'শপথ গ্রহণ' অঙ্কটুকু বাদ দেওয়া হয়েছে। সাক্ষ্যকে দুর্বল করা হয়েছে, আর এটা গ্রহণ করা বা না করার একচ্ছত্র ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে দুদক কর্মকর্তাদের। এর ফলে একদিকে সরকারি প্রভাবশালীদের বক্তব্য বিনাবাক্যে মেনে নেওয়া হচ্ছে, অন্যদিকে বিরোধীদের বক্তব্য গ্রহণ না করে তাদের বিরুদ্ধে মামলা করা হচ্ছে। তাই দুদক আইন এখন অনেকটাই নিবর্তনমূলক আইনে রূপ নিয়েছে।
সাত. বিগত কেয়ারটেকার সরকারের আমলে প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের নেতানেত্রীর বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলা থেকে সরকার ঢালাওভাবে তাদের নিজেদের বিরুদ্ধে দায়ের করা কয়েক হাজার মামলা প্রত্যাহার করে নিয়েছে। অন্যদিকে বিরোধী দলের একটি মামলাও প্রত্যাহার করা হয়নি। বরং সরকার দুদককে দিয়ে বিরোধী দলের পুরনো মামলা সচল করেছে এবং নতুন করে দুদককে দিয়ে বিরোধী দলের নেতাদের বিরুদ্ধে নতুন নতুন দুর্নীতির মামলা রুজু করিয়েছে। সরকার তার দুর্নীতি ও অর্থনৈতিক অস্বচ্ছতা-লুটপাট আড়াল করতে দুদককে একটি সাক্ষীগোপাল সংস্থায় পরিণত করেছে।
আট. সরকার এখন নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু বাস্তবায়নের ঘোষণা দিয়েছে। বিশ্বব্যাংকের ঋণচুক্তিতে দাতারা ২৯১ কোটি ডলারের মধ্যে ২৩৫ কোটি ডলার দশমিক ৭৫ শতাংশ সার্ভিস চার্জে দিতে সম্মত ছিল। তাও আবার ১০ বছর পর থেকে ঋণ শোধ করতে হতো। আর এখন আমাদের নিজেদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ভেঙে এ সেতু তৈরি করতে হবে। আমাদের কোটি কোটি প্রবাসীর হাড়ভাঙা খাটুনির রেমিট্যান্সের টাকা দিয়ে দুর্নীতির খেসারত দিতে হবে। আসলে দোষ দুদকের নয়, সব দোষ আমাদের জনগণের! না হলে দুর্নীতি দমনকারীরা কেমন করে দুর্নীতির পৃষ্ঠপোষক হয়ে ওঠে? দুর্নীতিবাজরা কী করে গণহারে পেয়ে যায় দায়মুক্তির সার্টিফিকেট? আবুলরা কী করে পেয়ে যায় দেশপ্রেমিকের সার্টিফিকেট?
লেখক : সুপ্রিমকোর্টের আইনজ্ঞ ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ