যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের চলমান আন্দোলন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম যৌন নিপীড়ন বিরোধী আন্দোলনের স্মৃতি মনে করিয়ে দিলো। বিএনপিপন্থী যৌন নিপীড়ক শিক্ষক শহীদুজ্জামানকে রক্ষা করতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল আওয়ামী প্রশাসন, ছাত্রলীগসহ কায়েমী সকল ব্যবস্থা। এমনকি আজ ভাবলে অবিশ্বাস্য বোধ হতে পারে, ছাত্র ফেডারেশন, বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রী এবং সহযোগী একটা দুটো সংগঠন বাদে বর্তমানে সক্রিয় সবগুলো মূলধারার বাম সংগঠনও এই আন্দোলনে সহযোগী ভূমিকা পাল ন করেনি, মোটাদাগে বলা যায় বিরোধিতাই করেছিল। প্রসঙ্গটা কেবল নিন্দা করার সুযোগে তোলা হচ্ছে না, বরং এই কারণে তোলা যে, যারা পরিবর্তনের বাহন হবে, তাদেরও শিখতে হয়, বিকশিত হতে হয়; যেমন আমরা নিজেরাও এই শিক্ষাটা গ্রহণ করেছিলাম তারও আগের সূর্যাস্ত আইন বিরোধী আন্দোলনে... অত বড় এবং সুদূরপ্রসারী একটা আন্দোলন হয়ে গেলো বিশ্ববিদ্যালয়ে, অথচ সাংগঠনিক আকারে বামপন্থীরা প্রায় নিষ্ক্রিয় ছিল সেই আন্দোলনে, যদিও আমাদের অনেক বন্ধু এবং সহকর্মী ব্যক্তিগতভাবে সেখানে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছিলেন।
গণতান্ত্রিক ছাত্র ঐক্য নামের বামপন্থী কয়েকটি সংগঠনের সক্রিয় একটি জোট তাদের প্রচারপত্রে যৌন নিপীড়ন বিরোধী আন্দোলনকে এনজিও মতাদর্শপুষ্ট বলেছিল; এমনকি আন্দোলের যে সংস্থা গড়ে উঠেছিল, যেখানে ছা্ত্র সংগঠনের পাশাপাশি সাংস্কৃতিক সংগঠন, ব্যক্তিগত অংশগ্রহণকারী সমেত বিভিন্ন স্তরের ও ধরনের মানুষের মিলন ঘটেছিল, সেই 'যৌন নিপীড়ন বিরোধী শিক্ষার্থীবৃন্দ'কেও ছাত্র সমাজকে রাজনীতিহীন করার চক্রান্ত হিসেবে উল্লেখ করেছিল! প্রতিক্রিয়ার সব মহলে মহা আলোড়ন তৈরি করেছিল আস্ত 'যৌন নিপীড়ন' শব্দটাই। বিশ্ববিদ্যাবলয়ের ভিসি থেকে শুরু করে মধুর ক্যানটিনে সহযোগী ছাত্র নেতারা কানে হাত দিয়ে আরেকদিকে ফিরে যেতেন, কেউ কেউ বেশ রগড়ও নিতেন। শিক্ষক সমাজের অবমাননা হিসেবেই এটাকে চিত্রিত করেছিলেন তাদের অধিকাংশ। সরকার আর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তো ভাবমূর্তি হননের ষড়যন্ত্র বলে আন্দোলনকে প্রচার করেছিল। প্রতিবাদে তখন দৈনিক সংবাদে (হায় সংবাদ!) কুদ্দুস নামের একজন কার্টুন এঁকেছিলেন, গায়ে ভাবমূর্তি লেখা কতগুলো কুকুর নারীশিক্ষার্থীদের তাড়া করছে! আন্দোলনে যে বিপুল নারী শিক্ষার্থী অংশ নিয়েছিলেন, তাদেরকে ভিসি আজাদ চৌধুরী ডেকেছিল গার্মেন্টের মেয়ে বলে, এর জবাব Anu ভাই দিয়েছিলেন একটা ঐতিহাসিক বক্তৃতায়, একদিকে যেমন গার্মেন্ট কর্মীর হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিয়ে এই অবমাননার চেষ্টায় এই ভিসির স্বরুপ বোঝা যায়, তেমনি আমরা সত্যি সত্যিই সেইদিন আনন্দিত হবো, সেইদিন সমাজে সত্যিকারের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে যেদিন গার্মেন্ট কর্মীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের এবং শিক্ষার্থীরা গার্মেন্টের শ্রমিকদের আন্দোলনের সাথী হবেন।
লাগাতার লাঞ্ছনা, প্রহার, ভীতিপ্রদর্শন, ক্যাডারদের থুথু ও জুতা নিক্ষেপ এবং হামলার মাঝেও আন্দোলন এগিয়ে চলে। মনে আছে একদিন মিছিলের মাঝে বিরাট একটা ইট এসে পড়লো কবিতা'দি, কবিতা চাকমার ঘাড়ে। একবার পেছনে ফিরে ভ্রুক্ষেপ না করে তিনি এগিয়ে চললেন। ইত্তেফাক আর জনকণ্ঠের এক সাংবাদিক, নামটা মনে পড়ছে না এখন, আন্দোলনের বিরুদ্ধে বীভৎস ধরনের সংবাদ প্রচার করতো, কিন্তু বাকি প্রায় সকল সাংবাদকর্মী, বিশেষকরে ভোরের কাগজের Roy Pinaki, প্রথম আলোর Tarun Sarkar, সাজু(ইউএনবি কি?), সংবাদের কৈলাশ সরকার বিরাট ভূমিকা রেখেছিলেন আন্দোলনের পক্ষে। ভয়ঙ্করতম হামলার দিনে শাহাদুজ্জামানের একটি কুশপুত্তলিকা দাহ করা হয় ডাকসু ভবনের পেছনে। ছাত্রলীগের সাধারণ কর্মীদের একটু উশখুশ দেখা গেলো এমন একটা ন্যায্য আন্দোলনে হামলাতে, অতএব সামনে এগিয়ে এলো ওপরের দুই সাংবাদিক লেবাসধারী, সে নারীশিক্ষার্থীদের হুমকির সুরে কার্ড দেখাতে বলে। সমান আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে যেইমাত্র বলা হলো তার কাজ সংবাদ সংগ্রহ, কার্ড দেখা না, একটু পিছিয়ে ইত্তেফাকের সাংবাদিকটিইপয়লা ঢিলটা ছুড়ে মারলো, তারপর শুরু হলো ভয়াবহ তাণ্ডব। অনেক জনকে সেদিন হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছি।
এই আন্দোলন ৯০ দশকের ছাত্র আন্দোলনের একটা মোড় ফেরা। এর আগে ওই সময়ে একমাত্র বেতন ফির আন্দোলনই উল্লেখকরার মত ছিল। কিন্তু যৌননিপীড়ন বিরোধী আন্দোলনের বিস্তার তুলনামূলকভাবে অনেক কম হলেও চেতনার মাত্রাগত দিক দিয়ে তা ছিল তুলনাহীন। মনে পড়ছে সাকি ভাইয়ের একটা বক্তৃতার কথা, ক্রমাগত কয়েকদিন হামলার পর সেইদিনের অপরাজেয় বাংলার সমাবেশে খুব কম জমায়েত ছিল, মোটে সত্তুর আশি জন হয়তো। কিন্তু দেখা গেলো কলাভাবনের বারান্দায় অজস্র ছেলেমেয়ে উৎসুক দাঁড়িয়ে আছে। সাকি ভাই সেদিন অবিশ্বাস্য একটা বক্তৃতা দিলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে যৌননিপীড়নের পেছেন, তার বোনের-সহপাঠীর-বান্ধবীর ওপর হামলর মদদদাতা হিসেবে কিভাবে শিক্ষার্থীদের নিষ্ক্রিয়তাই প্রধানত দায়ী, কিভাবে তারা মাথা নিচু করে হলে ঢোকে আর তাদের পাহারা দেয় তারা, যারা যৌন নিপীড়কেরও পাহারাদার। এর প্রভাব হয়েছিল অবিশ্বাস্য, দলে দলে শিক্ষার্থীরা কলাভবন থেকে নেমে সংহতি সমাবেশে যোগ দেয়, অন্তত ওইদিনের আয়োজন আশাতীতভাবে সফল হয়।
আন্দোলনটার একা তাৎপর্য হলো ৯০ এর আমাদের বেশিরভাগ বন্ধুই যারা এখনো নানান সামাজিক স্তরে সক্রিয় আছেন, প্রায় সবাই ওই আন্দোলনের নেতা-কর্মী-সংগঠক হিসেবে কাজ করেছেন। রূপরেখা নির্ধারণে সাকি ভাই অন্তত আমাদের কাছে প্রধান ভূমিকা পালন করেছেন, আমাদের সংগঠনের তাসলিমা আখতার, শ্যামলী শীলসহ অন্যরা, সূচনা অধ্যয়ন কেন্দ্রের আবুল হাসান রুবেল, প্রপদের শাপলা-মুন্নীসহ আরও অনেক রাজনৈনিক কর্মীর পাশাপাশি ফারজানা রূপা, তাসলিমা মিজি বহ্নি, পুতুল সুলতানা, সামিনা লুৎফা নিত্রাসহ আরও অনেকেরই নাম মনে পড়ছে।
ছফা ভাইযের কথা বলতেই হয়। শুরুর দিকের একটা আয়োজনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একমাত্র জৈষ্ঠ্য শিক্ষক হিসেবে উপস্থিত থাকতে সম্মতি দিয়েছিলেন সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। জাহাঙ্গীরনগর থেকে আসবেন আনু মুহাম্মদ। আহমদ ছফা কেন্দ্রীয় লাইব্রেরির সামনে আয়োজিত সেই সমাবেশে বললেন, তার স্বভাবসিদ্ধ উপহাসের ভঙ্গিতে, বাকিসব বিখ্যাত শিক্ষক আর বুদ্ধিজীবীদের প্রতি ইঙ্গিত করে: বলেছিলাম না ওরা আসবে না! ওরা আসে না। ওদের কথাই তো তিনি লিখেছেন গাভী বৃত্তান্তে...
না এলেও সারাজীবন মনে রাখার মত একটা কাজ করেছিলেন প্রয়াত অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদ। শিক্ষক সমিতির নির্বাচনের দিন তিনি ঢোকার মুখেই একটা প্লাকার্ড হাতে বসেছিলেন সারাদিন, ভোট দেননি। প্লাকার্ডটাতে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির নির্বাচনকে উপহাস করা হয়েছিল, যে বিশ্ববিদ্যালয়ে যৌন নিপীড়ন হয়, সেখানে কিভাবে ভোট হয়! প্রতিবাদের এটা শি ছিল সবচে শক্তিশালী প্রতীক। আন্দোলনের যে কর্মীদের তাদের শিক্ষকরা দিবারাত্র উপহাস করতেন, তারা সারাদিন ঘিরে থাকলো প্রবীণ অধ্যাপককে, আর ওই শিক্ষকরা পারলে অদৃশ্য হযে যান, কোন ক্রমে নিজেদের দেহটাকে আড়াল করে চলে যাচ্ছিলেন। মোজাফফর সাহেবের বহু ভূমিকার নিন্দা ও বিরোধিতা করে যাবো, কিন্তু ওই এক ঘটনা আমাদের স্মৃতিতে তাঁকে লোকোত্তোর মর্যাদা দিয়েছে।
আরও একটা স্মৃতি মনে পড়ে। প্রাধান্যশীল কয়েকটি বাম সংগঠন যৌন নীপড়ন প্রশ্নে নেতিবাচক ভূমিকা রাখলেও তাদের সক্রিয় কর্মিদের একটা বড় অংশও গভীরভাবে আলোড়িত হয়েছিল। তাদের বিষাদমাখা মুখগুলোও মনে পড়ছে যখন তাদের বোনেরা-ভাইয়রা মার খাচ্ছে, লাঞ্ছিত হচ্ছে আর তাদের নেতাদের হা-হা-হি-হি দেখতে হচ্ছে ওই ক্যডারদের সর্দারদের সাথে, উপাচার্যসমেত প্রশাসনের কর্তাদের সাথে। তাদের মনের এই ক্ষত পরবর্তীতে কাজ করেছিল সাম্রাজ্যবাদ প্রশ্নে, খনিজ সম্পদ প্রশ্নে ক্লিনটনের বাংলাদেশে সফলের কালে ছাত্র সংগঠনগুলোকে এক কাতারে আসতে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌন নিপীড়ন বিরোধী আন্দোলনে ভূমিকাহীনভবেই অপসৃত হয় গণতান্ত্রিক ছাত্র ঐক্য। অথচ এর ছিল বিপুল গণতান্ত্রিক সম্ভাবনা। মইন হোসেন রাজু প্রকৃত অর্থে গণতান্ত্রিক ছাত্র ঐক্যের শহীদ, ওই মিছীলে অংশ নেয়া অন্য যে কেউ কিংবা একাধিকও সন্ত্রাস বিরোধী সেই মিছিলে বলি হতে পারতেন।
পরবর্তীতে জাহাঙ্গিরনগরে ধর্ষণ বিরোধী আন্দোলন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই আন্দোলন উভয়টিতেই বহু অনর্জন থাকলেও ভবিষ্যতের ইতিহাসে এই দুটি আলাদাভাবে চিহ্নিত হবে যে মৌলিক প্রশ্ন, নারীর নিরাপত্তা ও সমতা এবং গণতান্ত্রিক আন্দোলনের কাঠামো বিষয়ে নির্ধরণসূচক ভূমিকা রাখার জন্য। পরবর্তীতে কোন আন্দোলন এই প্রশ্নগুলোকে বাদ দিয়ে হতে পারেনি।
যাদবপুরের শিক্ষার্থীদের এই আন্দোলনের সর্বাঙ্গীণ সাফল্য কামনা করি। উপাচার্যদের প্রতিক্রিয়াও দেখা গেলো কাছাকাছিই। হয়তো শান্ত নিস্তরঙ্গ ওই প্রতিষ্ঠানে বহু বছর বাগে এটিই প্রথম ঢেউ। অচলায়তনে সাড়া জাগলে পরেরকার কোন সংগ্রামকেই এ থেকে আলাদা করে আর দেখা যাবে না।