আওয়ামী লীগের কীর্তিস্তম্ভ এই মন্বন্তর
- আহমদ ছফা
"... এই মন্বন্তরের আসল কারণ বন্যা নয়, সাইক্লোন নয়, খরা, জলোচ্ছাস কিংবা আকস্মিক নৈসর্গিক বিপদাপদ এর কোনটাই নয়। এই মন্বন্তর সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায়, আওয়ামী লীগারদের একটানা তিন বছরের নির্মম লুন্ঠন, হৃদয়হীন চৌর্যবৃত্তি, তুলনাবিহীন সম্পদ পাচার্, অপচয়, ধ্বংস এবং অদূরদর্শী পররাষ্ট্রনীতির সমূহ ফলশ্রুতি।
বন্যা না হলেও এই মন্বন্তর ঠেকাবার কোন যাদুমন্ত্র শেখ মুজিব সরকারের ছিল না। সাম্প্রতিক বন্যা শুধু আওয়ামী লীগের প্রসিদ্ধ তস্করদের দেশে-বিদেশে জাহির করার মত একটা অছিলা এনে দিয়েছে। তাই শেখ মুজিব মনের সুখে গোঁফে তা দিয়ে দেশবাসীর কাছে সেদিন কাঁদো কাঁদো মুখ করে বললেন, ভাইসব, অনেককিছু দেবার ইচ্ছে ছিল, কিন্তু বন্যা এসে আমার সব সাধ, সব সাধনা ভাসিয়ে নিয়ে গেল। আমাকে ভুল বুঝবেন না ইত্যাদি ইত্যাদি। আর বিদেশিদের কাছে পরম নিশ্চিন্তে বলে বেড়াচ্ছেন, আমরা তো দেশ গঠনের কাজ বেশ সুন্দরভাবেই করে আসছিলাম, কিন্তু সর্বনাশা বন্যায়ই আমাদেরকে হালে একটু বেকায়দায় ফেলে দিয়েছে।
এই মন্বন্তর বাংলাদেশের জন্য অবধারিত ছিল। কিছুই একে ঠেকাতে পারত না। তবে বন্যার ফলে যে মন্বন্তর আশ্বিন মাসে স্বরূপ প্রকাশ করেছে, হয়ত আরো দুয়েক মাস সময় নিত। ফাগুনের শেষে চোতে-বোশেখে অবশ্যই দেখা দিত। বাংলাদেশে উনিশশো উনসত্তর সালের জল প্লাবনের সময় প্রাণ এবং সম্পদের যে ক্ষয়-ক্ষতি হযেছে, বর্তমান বন্যায় ক্ষয়-ক্ষতি কি তার চেয়ে ভযাবহ? সেই প্রবল সামুদ্রিক জলোচ্ছাসের স্মৃতি এখনো একেবারে মিলিয়ে যায়নি। একটা তুলনামুলক হিসেব কষাও বোধকরি অসম্ভব নয়। উনসত্তরের সামুদ্রিক জলোচ্ছাসের পর দেশব্যাপী হা-অন্ন হা-অন্ন এমন হাহাকার ওঠেনি, মানুষের লাশ এমনি পথে-ঘাটে পড়ে থাকতে দেখা যায়নি, অর্ধমৃত কঙ্কালসার নয়, উদোম নর-নারীর ক্লান্তিহীন মিছিল শহরের রাজপথে ধুঁকে ধুঁকে মরবার জন্য এমন মরিয়া হয়ে ছুটে আসেনি। জিনিসপত্রের দাম একলাফে আকাশে চড়ে নাগরিক সাধারণের জীবনকে এমন বিপর্যস্ত করে তোলেনি।
গ্রাম-গ্রামান্তরে পাঁচ টাকায় মা ছেলে বিক্রি করছে, সরলা কিষাণ বালাও আট আনায় বিকোচ্ছে ইজ্জত। বাবা ছেলেকে ফেলে দিয়ে প্রাণ ধারনের নিষ্ঠুর তাগিদে ছুটে পালাচ্ছে। স্ত্রী স্বামীকে ছেড়ে চলে যাচ্ছে, স্বামী স্ত্রীকে।
এই মন্বন্তর বন্যার কারনে হয়েছে, কি আওয়ামী লীগারদের কারনে হয়েছে, সে কথা আজ ঠান্ডা মাথায় বিচার করে দেখবার মতো মানসিক স্থৈর্য খুব কম মানুষেরই আছে। সমাজের স্থিরবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষদেরও বুদ্ধি-বিবেচনা আজ গুলিয়ে একাকার হয়ে গেছে। চূড়ান্ত হতাশ, অসহায় দৃষ্টিতে তারাও নীরব দর্শকের মত তাকিযে তাকিয়ে দেখছেন। বাংলাদেশের শহরগুলোতে স্রোতের জলের মত কঙ্কালসার নর-নারী, শিশু-বৃদ্ধের ঝাঁক এসে ভিড় করছে। কানায় কানায় ভরিয়ে তুলছে সমগ্র শহর। নগরীর বাতাসে মানুষ পঁচা লাশের ঘ্রাণ, নগরীর রাজপথে মুখ থুবড়ে পড়ে থাকা লাশ, ফাঁকা জায়গাগুলোতে কিলবিল করছে ভুখা-নাঙ্গা মুমূর্ষ মানুষের জটলা। এদের অল্পকদিন আগেও ঘর ছিল, ঘরের মায়া ছিল, সংসার ছিল, সংসারের বাঁধন ছিল, বুকে স্বপ্ন ছিল, ছিল অন্তরে মমতা। সুখে-দু:খে, সম্পদে-বিপদে গ্রাম বাংলার ছোট ছোট কুটিরে স্ত্রী পুত্র পরিজন বেষ্টিত পরিবারগুলোতে প্রাণ-প্রবাহের যে রস, যে মাধুর্য উছলে উঠত সব পেছনে ফেলে এরা শহরের রূঢ় রৌদ্রে এসে দাঁড়িয়েছে। আজ তাদের ঘর নেই - ঘরের মায়া উধাও, সংসার নেই, সঙ্গম নেই, বুকের স্বপ্ন কচি মুকুলের মত কবে ঝরে গেছে। জীবন ধারণের নিষ্ঠুর গ্লানি অবনত মস্তকে বয়ে দোরে দোরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ভাত চাই। ভাত নেই তো ফ্যান দাও। ফ্যান যদিও বা না দেবে অন্য কিছু দাও।
ঘর-দোর সমাজ-সংসার সব গেছে - এই কষ্টক্লিষ্ট প্রাণটাকে বাঁচিয়ে রাখার তাগাদা আমাদেরকে শহরে ছুটিয়ে নিয়ে এসেছে। নগরী নিষ্ঠুর্, নগরী ফলে ফলে হেসে ছলছল স্রোতে বয়ে যায়। আর ভাদ্র মাসে তেজালো রোদে পুঁটি মাছ যেমন মরে, তেমনি করে প্রতিদিন শয়ে শয়ে হাজারে হাজারে মানুষ অমৃতের পুত্র মানুষ মৃত্যুর হিমশীতল কোলে ঢলে পড়ছে।
শেখ মুজিবের সরকার বলবার মত একটা কথা পেয়েছে। দেশের মানুষ মরছে তার কারণ বন্যা। দেশে মন্বন্তর কালো ছায়া প্রসারিত করেছে তার কারণ বন্যা। জিনিসপত্রের দাম লাফে লাফে চন্দ্রলোকের দিকে ধাবমান - তার কারন বন্যা।
আপনি বাঙালি জাতির পরম শ্রদ্ধেয় পিতৃদেব। রক্ষীবাহিনী, ঠেঙ্গারেবাহিনী দিয়ে গোটা জাতির সাড়ে সাতকোটি মানুষকে বেয়নেট বুলেটের মুখে দাবিয়ে রেখে তিন বছর তিন বছর গত হবার পূর্বেই আপনার পিতৃস্নেহের স্বরূপ প্রকটিত হল। বাংলাদেশকে আপনি ইতিহাসে নজিরবিহীন একতা মন্বন্তর উপহার দিলেন। আশ্চর্য শক্তিমান পুরুষ আপনি, তুলনাবিহীন আপনার বাকচাতুরী, যাদুময় আপনার কন্ঠধ্বনি। এই বাংলাদেশে যখন আপনার সুশাসনে হাজার হাজার মানুষ প্রতিদিন মারা যাচ্ছে - আর আপনার দলের লোকেরা সেই মৃত, অর্ধমৃত মানুষের হাড়-গোড়, চর্বি-মাংশ সাম্রাজ্যবাদী বন্ধুদের কাছে বেঁচে দিয়ে অর্জিত সম্পদের পরিমাণ আরো বৃদ্ধি করবার পরিকল্পনা করছে /
এই প্রাকৃতিক দূর্যোগ বন্যা আর আপনার আওয়ামী লীগ দু'য়ের মধ্যে কে বেশি ভয়ংকর? গ্রাম-বাংলাকে নগ্ন করে গতরের মাংশ কে বেশি খুবলে নিয়েছে? জল-বন্যার ডাকাত আর আওয়ামী লীগের ডাকাত উভয়ের মাঝে কে বেশি হিংস্র? জিজ্ঞেস করুন, জবাব পাবেন; জিজ্ঞেস করুন একফোঁটা দুধের অভাবে মরনের মুখে ঢলে পরা শিশুর কাছে; জিজ্ঞেস করুন গ্রাম বাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে আগত আট আনায় ইজ্জত বিকানো সরল কিষাণ বউয়ের কাছে; জিজ্ঞেস করুন অচল কল-কারখানার লোহালক্করের কাছে; জিজ্ঞেস করুন আওয়ামী লীগকে মোটা চাঁদা দেয়া চোরাচালানীদের কাছে; জিজ্ঞেস করুন আপনাদের সঞ্চিত সোনাদানার আমানতদার বিদেশী ব্যাংকের ম্যানেজারদের কাছে; জিজ্ঞেস করুন আপনার মন্ত্রীসভার স্ফীতোদর, স্থূলকায় মন্ত্রীদের কাছে; জিজ্ঞেস করুন আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হওয়া আওয়ামী লীগের কর্মীদের, জিজ্ঞেস করুন অর্থনীতি শাস্ত্রের কাছে। স্পষ্ট জবাব পাবেন - এই মন্বন্তর, এই দুর্ভিক্ষ, এই মাৎস্যন্যায় আওয়ামী লীগের তিন বছরের শাসনকালের অনুপম কীর্তিস্তম্ভ॥" - গণকন্ঠ / ১৫ই অক্টোবর, ১৯৭৪ইং
- আহমদ ছফা / প্রবন্ধ সমগ্র - তৃতীয় খন্ড ॥ [ হাওলাদার প্রকাশনী - জুন, ২০১৪ । পৃ: ২৩১-২৩৩ ]
__._,_.___
Pl see my blogs;
Feel free -- and I request you -- to forward this newsletter to your lists and friends!