অবৈধ ভিওআইপিতে ভিআইপিরা
* রাঘব-বোয়ালদের কারণে বন্ধ হচ্ছে না * এই টাকায় হতো চারটি পদ্মা সেতু
অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছে অবৈধ বৈদেশিক টেলিফোন কল আদান-প্রদানের ভয়েস ওভার ইন্টারনেট প্রটোকল (ভিওআইপি) বাণিজ্য। গত তিন বছরে এ অবৈধ বাণিজ্যের মাধ্যমে সংঘবদ্ধ সিন্ডিকেট হাতিয়ে নিয়েছে অন্তত ১৫ হাজার কোটি টাকা। ধরাছোঁয়ার বাইরে অবস্থানকারী রাঘব-বোয়ালদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহায়তায় নানামুখী সিন্ডিকেট এই অবৈধ ভিওআইপি করে চলেছে।
দেশে-বিদেশে অবস্থানকারী প্রভাবশালী চক্রের নেটওয়ার্কের কাছে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাও অনেকটা জিম্মি। ফলে মাঝেমধ্যে অভিযান পরিচালিত হলেও বেশির ভাগ সময় তারা নীরব অবস্থানে থাকে। এ কারণে লুটেরা সিন্ডিকেট নিজেদের ধরাছোঁয়ার বাইরে মনে করছে। অথচ অবৈধ ভিওআইপি ব্যবসা থেকে সরকারের যে বিপুল পরিমাণ টাকা সিন্ডিকেট লুটে নিয়েছে, তা দিয়ে কয়েকটি পদ্মা সেতু নির্মাণ করা সম্ভব হতো।
এ সিন্ডিকেটের সঙ্গে যোগসাজশের মাধ্যমে রাজধানীসহ সারা দেশে জমে উঠেছে অবৈধ ভিওআইপি বাণিজ্য। দেশি ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি বড় আকারে এ বাণিজ্য ফেঁদে বসেছেন বিদেশিরা। র্যাবসহ পুলিশ ও গোয়েন্দা বিভাগের অব্যাহত অভিযানে মাত্র ছয় মাসেই ২৬ জন বিদেশিসহ দুই শতাধিক ভিওআইপি ব্যবসায়ীকে ধরা সম্ভব হয়েছে। তাদের কাছ থেকে উদ্ধার করা হয়েছে চার হাজার কোটি টাকা মূল্যমানের সরঞ্জাম।
এর পরও থেমে নেই ভিওআইপির অবৈধ বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ড। মূল নায়করা ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকায় বন্ধ হচ্ছে না এই ভিওআইপি ব্যবসা।ইতিমধ্যে ৮১৩ কোটি টাকা সরকারি রাজস্ব ক্ষতি ও আত্মসাতের সঙ্গে জড়িত অভিযোগে বিটিসিএলের অনেক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে পৃথক পাঁচটি মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। পাঁচ মামলার বিবরণে দেখা যায়, সিঙ্গাপুরের প্রাইভেট ক্যারিয়ার ডিজিটেক ৯৬ কোটি ৪১ লাখ ৯৯ হাজার ৪৬৪ টাকা, আই পাওয়ার ৪৪ কোটি ৯৬ লাখ ৯৪ হাজার ১৭৭ টাকা ও এনটিএস গ্লোবাল ২৪ কোটি ৩৯ লাখ ৫৩ হাজার ৩২৮ টাকা, যুক্তরাষ্ট্রের অ্যারিস্টো কল ১৫ কোটি ৫১ লাখ চার হাজার ১০৭ টাকা এবং যুক্তরাজ্যের সিম্পল টেলিকম আÍসাৎ করেছে ২৩ কোটি ৬৯ লাখ ৬০ হাজার ২৯২ টাকা।
এদিকে সাম্প্রতিক সময়ে সর্বাধুনিক প্রযুক্তি রেডিওলিঙ্কের মাধ্যমে রাজধানীর ভিআইপি এলাকায় বিস্তৃত হচ্ছে অবৈধ ভিওআইপি ব্যবসা। রাজধানীতে হাই ফ্রিকোয়েন্সি রেডিওলিঙ্ক ব্যবহার করে ভিওআইপির অবৈধ ব্যবসা করছেন অনেকে। রাজধানী ছাড়াও এ প্রযুক্তির মাধ্যমে অবৈধ ভিওআইপি ব্যবসা ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে বিভাগীয় ও বড় জেলা শহর এবং দেশের সীমান্ত এলাকায়। একদিকে অত্যাধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার, অন্যদিকে ভিআইপিদের সংশ্লিষ্টতায় অবৈধ ভিওআইপি ব্যবসায়ীদের সামনে অসহায় হয়ে পড়েছে বিটিআরসি। অবৈধ বাণিজ্যের কবলে গত তিন মাসেই সরকার রাজস্ব হারিয়েছে ৩১৬ কোটি টাকা। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে এসব তথ্য।
জানা গেছে, দেশে ও বিদেশে অবস্থানকারী প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গ, ব্যবসায়ী, রাজনৈতিক নেতা, টেলিকম মন্ত্রণালয়, রেগুলেটরি সংস্থা বিটিআরসির কতিপয় কর্মকর্তার সমন্বয়ে গঠিত একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট অবৈধ এ ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। প্রতি মাসে হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার করে ভাগ-বাটোয়ারা করে লুটে নিচ্ছেন সিন্ডিকেট সদস্যরা। প্রভাবশালীরা এতটাই শক্তিশালী যে তাদের কারণে কোনোভাবেই বন্ধ করা যাচ্ছে না এই অবৈধ বাণিজ্য। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকারের যে বিপুল পরিমাণ টাকা সিন্ডিকেট লুটে নিয়েছে, অবৈধ ভিওআইপি ব্যবসা করা হলে ওই টাকায় দেশে চারটি পদ্মা সেতু নির্মাণ করা সম্ভব হতো।
বিটিআরসির এক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানান, রাজধানীর ভিআইপি এলাকায় বেশ কিছু বাড়ি চিহ্নিত হয়েছে, যেগুলোতে পরিচালিত হচ্ছে অবৈধ ভিওআইপি। কিন্তু এ বাড়িগুলো ভিআইপি ব্যক্তিদের। এ ছাড়া গুলশান-২ এলাকায় একটি বাড়িকে তারা চিহ্নিত করেছেন, যেটি থেকে অবৈধ ভিওআইপি ব্যবসার অনেকাংশ নিয়ন্ত্রণ হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, রাতারাতি কাঁচা টাকা কামানোর অন্যতম মাধ্যম অবৈধ ভিওআইপি ব্যবসা এখন রাজধানীর বিভিন্ন আবাসিক এলাকায় ছড়িয়ে পড়েছে। বিশেষ করে ভিআইপি এলাকায় ভিআইপি হিসেবে পরিচিত কিছু ব্যক্তির ফ্ল্যাট ও অ্যাপার্টমেন্টে অবাধে চলছে এ ব্যবসা। কিন্তু ভিআইপি ব্যক্তিদের সেসব ফ্ল্যাট ও অ্যাপার্টমেন্টে অভিযানের সাহস দেখাচ্ছে না কেউ। আবার অনেক ক্ষেত্রে অভিযান চালালেই সংশ্লিষ্টদের পড়তে হচ্ছে ঝামেলায়। অভিযানের সঙ্গে সঙ্গে বিশেষ কিছু জায়গা থেকে ফোন চলে আসছে এবং জড়িতদের ছেড়ে দেওয়াসহ ওই সব স্থানে অভিযানেও থাকছে অলিখিত নিষেধাজ্ঞা।
বিটিআরসি ও তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, দীর্ঘদিন এ ব্যবসা রাজধানী ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেটে সীমাবদ্ধ থাকলেও এখন তা ছড়িয়ে পড়েছে বিভাগীয় এবং দেশের বড় শহরগুলোতে। এ ব্যবসা চলছে অত্যাধুনিক রেডিওলিঙ্ক প্রযুক্তির মাধ্যমে। এদিকে অবৈধ ভিওআইপি বন্ধে নানা পদক্ষেপ নিলেও সুফল মিলছে না। গত কয়েক মাসে অবৈধ ভিওআইপি বাণিজ্যের অভিযোগে ৭১ লাখ মোবাইল সিম ও এক লাখ আইটি অ্যাড্রেস বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। কয়েকটি মোবাইল অপারেটরকে করা হয়েছে মোটা অঙ্কের জরিমানা। তবু থামছে না সর্বগ্রাসী এ বাণিজ্য। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকেও অবৈধ ভিওআইপি কল টার্মিনেশন বন্ধে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে তাগিদ দেওয়া হয়েছে। এক চিঠিতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে যত শিগগির সম্ভব ভিওআইপি মনিটরিংয়ের জন্য সিএমএস স্থাপনের। একই সঙ্গে অবৈধ ভিওআইপি কল টার্মিনেশন বন্ধে মহাখালী ও মগবাজার টেলিফোন এক্সচেঞ্জের কর্মকর্তাদের প্রতি নজরদারি বাড়ানোর পরামর্শও দেওয়া হয়।সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, অবৈধ ভিওআইপি সিন্ডিকেটের হোতারা গত বছর বিটিসিএলের দেড় হাজার কোটিরও বেশি টাকা বিদেশে পাচার করেছে। বিটিসিএলের আরেকটি প্রকল্প কৌশলে অনুমোদন করিয়ে নিয়ে এখান থেকে ২৫ কোটি টাকা আত্মসাতের সব বন্দোবস্ত পাকা করেছে একই চক্র।
দুদকের তদন্তে প্রমাণিত অবৈধ ভিওআইপি দুর্নীতির মামলায় অভিযুক্ত বিটিসিএলের উচ্চপর্যায়ের এক কর্মকর্তা আসামি হলেও তিনি ধরাছোঁয়ার বাইরে। এ ছাড়া অবৈধ ভিওআইপি গডফাদার খ্যাত বিটিসিএলের এক কর্মকর্তা, যিনি বারবার চাকরি থেকে বরখাস্ত হয়েছেন, একাধিক ফৌজদারি ও দুর্নীতির মামলায় অভিযুক্ত হয়ে গ্রেফতার হয়েছেন তিনি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অর্থনৈতিকভাবে দেশকে পঙ্গু করা এই ব্যবসা বন্ধে সরকারের কোনো পদক্ষেপই কাজে আসছে না। রাঘব-বোয়ালরা সরাসরি জড়িত থাকায় কোনোভাবেই বন্ধ করা যাচ্ছে না অবৈধ ভিওআইপি।
হালে পরিস্থিতি এমন ভয়ঙ্কর পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, অবৈধ এ ব্যবসার প্রসারে সরকারের উচ্চপর্যায় রীতিমতো উদ্বিগ্ন।ক্ষমতাসীন সরকার তার বিগত মেয়াদে এ খাত থেকে মহালুটপাট বন্ধ করতে পারেনি। বরং অভিযোগ রয়েছে, ক্ষমতাসীনদের রাজনৈতিক প্রভাবের ছত্রচ্ছায়ায় থেকে দেশি-বিদেশি অবৈধ ভিওআইপি কারবারিদের সিন্ডিকেটের ব্যাপকতা আরও বেড়ে যায়। ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালীরা একের পর এক ইন্টারন্যাশনাল গেটওয়ের (আইজিডব্লিউ) লাইসেন্স নিয়ে জড়িয়ে পড়েন ভিওআইপির মাধ্যমে অবৈধ কল টার্মিনেশনে।
বিভিন্ন গবেষণা সংস্থার প্রাপ্ত তথ্য ও টেলিকম বিশেষজ্ঞদের অভিমত, অবৈধ আন্তর্জাতিক কল টার্মিনেশনে গত পাঁচ বছরে প্রায় চার হাজার কোটি টাকার রাজস্ব হারিয়েছে সরকার। আর কল চুরি থেকে গত পাঁচ বছরে অবৈধ আন্তর্জাতিক কল ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের আয় হয়েছে প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকা। অনুসন্ধানে জানা গেছে, প্রশাসনের জ্ঞাতসারেই অবৈধ ভিওআইপি ব্যবসা থেকে বছরে হাজার হাজার কোটি টাকা লুটে নিয়েছে প্রভাবশালী চক্র। একসময় এই হাইটেক ব্যবসা গোপনে চললেও এখন তা অনেকটাই ওপেন সিক্রেট।
মাঝেমধ্যে বিটিআরসি সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে লোক-দেখানো অভিযান চালালেও তাতে কোনো ফল আসছে না। অভিযোগ আছে, সংস্থাটির শীর্ষ কয়েকজন কর্মকর্তার মদদে রাঘব-বোয়ালরা নির্বিঘ্নে চালিয়ে যাচ্ছে এ অবৈধ বাণিজ্য। বিটিআরসির কর্মকর্তাদের তথ্যমতে, রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান বিটিসিএল ও মোবাইল ফোন অপারেটর কোম্পানি টেলিটকের মাধ্যমেই পরিচালিত হচ্ছে সিংহভাগ অবৈধ ভিওআইপি ব্যবসা। ২০০৮ থেকে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বিটিআরসির মনিটরিং বিভাগের প্রতিবেদন অনুযায়ী, অবৈধ ভিওআইপির শীর্ষে ছিল বিটিসিএল ও টেলিটক। প্রতিষ্ঠান দুটিকে বারবার সতর্ক করা হলেও পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি।
এ নিয়ে বিটিআরসি, টেলিযোগাযোগ সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি ও দুদক একসঙ্গে অনুসন্ধান শুরু করে। ২০১৩ ও ২০১৪ সালে বিটিসিএলের ২৬ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলাও করে দুদক। কিন্তু রাঘব-বোয়ালরা ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে যায়। এর আগে ১৭ এপ্রিল রাজধানীর বংশাল এলাকা থেকে বিপুল পরিমাণ অবৈধ ভিওআইপি সরঞ্জাম জব্দ করে র্যাব-১০। ৪ মে চট্টগ্রাম নগরীর মেহেদীবাগ, চট্টেশ্বরী রোড, খাতুনগঞ্জ ও চকবাজারে অভিযান চালিয়ে দুই কোটি টাকার অবৈধ ভিওআইপি সরঞ্জামসহ নয়জনকে আটক করা হয়। ৬ মে রাজধানীর কল্যাণপুরের ২২ নম্বর লেকভিউ সড়কের ৪১৩/এ নম্বর বাসা থেকে বিপুল পরিমাণ ভিওআইপি সরঞ্জাম উদ্ধার করে সংস্থাটি। ১৮ মে চট্টগ্রাম নগরীর হালিশহর এলাকায় অভিযান চালিয়ে বিপুল পরিমাণ ভিওআইপি সরঞ্জামসহ একজনকে আটক করা হয়। এ ছাড়া রাজধানীতে মিষ্টির দোকানের আড়ালে এ ব্যবসা করার অভিনব কায়দাও পুলিশ ফাঁস করেছে।
জানা গেছে, অবৈধ ভিওআইপি ব্যবসায় জড়িত থাকার অভিযোগে গত এক দশকে সাড়ে ছয় হাজার মামলা হলেও কারও সাজা হয়নি। প্রভাবশালীদের দৌরাÍ্য ও সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর গাফিলতি আর আইনের ফাঁকফোকরে ঝুলে আছে মামলাগুলো। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তথ্য ও আদালত সূত্রে জানা গেছে, দেশের বিভিন্ন আদালতে প্রায় সাড়ে ছয় হাজার অবৈধ ভিওআইপির মামলা রয়েছে। এর মধ্যে অবৈধ ভিওআইপি ব্যবসায় সরাসরি জড়িত থাকার অভিযোগে করা মামলার সংখ্যা দেড় হাজার।
Pl see my blogs;
Feel free -- and I request you -- to forward this newsletter to your lists and friends!