শ্রীশুভ্র।
সর্বনাশটা শুরু হয়েছিল নকশাল আন্দোলনের সামূহিক ব্যার্থতার সরাসরি কুফল থেকেই। রাজ্য মেধাশূন্য এক মধ্যমেধার রামরাজত্বে পরিণত হয়ে গেল। সবচেয়ে বড়ো ক্ষতি এইটাই যে মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের মানসিকতায় দেশ সমাজ ও জাতির আর কোনো প্রাসঙ্গিকতাই রইল না। কেবলমাত্র নিজের পেশাগত উন্নতিই জীবনের প্রধানতম লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ালো। যার ফলে দেশ থেকে মেধা নিষ্ক্রমণ হয়ে দাঁড়ালো যুগধর্ম। আর এই বিষয়ে সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের কংগ্রেসী প্রশাসন চূড়ান্ত সফল হয়েছিল তাদের প্রশাসনিক তৎপরতায় ও বর্রবতায়। ভীত সন্ত্রস্ত অভিভাবকমণ্ডলী নিজেদের সন্তানদেরকে রাজনীতির প্রাঙ্গন থেকে সড়িয়ে নিতে ব্যগ্র হয়ে উঠলেন। আর সেই শূন্যতা ভরাট করতেই রামরাজত্ব শুরু হলো মধ্যমেধার।
এরাজ্যে সত্তর দশকের মধ্যভাগ থেকেই এই সংস্কৃতি গ্রাস করলো গোটা সমাজ জীবনকে। মেধাবী ছাত্রছাত্রীরা মনে করল প্রত্যক্ষ রাজনীতি চর্চার নীট ফল শূন্য; তাই তারা নিজেদের পেশাগত উন্নতিকেই পাখির চোখ করা শুরু করল। বাবা মায়েরাও ছেলে মেয়েদের ডাক্তার ইঞ্জীনীয়র করার ইঁদূর দৌড়ে ঠেলে দিতে থাকলেন। কারণ নকশাল আন্দেলনের চূড়ান্ত ব্যর্থতার সুযোগে মধ্যমেধার বুদ্ধিমানেরা ততদিনে সব পাদপ্রদীপের আলোতে আলোকিত হতে শুরু করে দিয়েছে! ছাত্রদের চেতনায় দেশ ও জাতি গঠনের নতুন দিনের স্বপ্ন দেখার যুগের অবসান ঘটল খুব দ্রুত। আর এই সুযোগে- কংগ্রেসী আমলের অবসান ঘটিয়ে সদ্য ক্ষমতায় আসা সিপিএম তাদের তিন দশকের সাম্রাজ্য বিস্তারে হাতিয়ার করলো এই মধ্যমেধা চর্চার পরিসরটিকেই। সেই পথেই গোটা শিক্ষা ব্যবস্থাই হয়ে উঠল সিপিএম-এর ভোটব্যাঙ্কের সেফটি ভল্ট।
সেদিন জ্যোতিবসুর নেতৃত্বাধীন সিপিএম বোঝেনি এই ব্যবস্থা গোটা জতির পক্ষেই একদিন চূড়ান্ত অভিশাপ হয়ে দেখা দেবে। বোঝেনি কারণ, বোঝার জন্যে যে রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও দেশপ্রেম লাগে, সেটা তাদের ছিল না। তাদের কাছে পার্টির প্রশাসনিক ক্ষমতায়ন ও সেই শক্তি ধরে রাখাই মূল বিবেচ্য ছিল। দেশ গঠন ও জাতি গঠনে সমাজবিপ্লবের যে ভূমিকা, সেই ভুমিকা পালন করার মতো কোন যোগ্যতাই এই পার্টি ও তার কোনো নেতৃত্বেরই ছিল না। তার ফল স্বরূপ ক্ষমতার ননী মাখন খেতে পার্টিতে বেনোজল ঢোকার রাস্তাটাও বিশাল রাজপথ হয়ে গেল। আর সেই পথেই সিপিএম-এর হাত ধরে এরাজ্যে দূর্নীতির বিকেন্দ্রীকরণ ঘটল খুব দ্রূত! যার ফলে সামাজিক অবক্ষয়ের পরিসরটি বিস্তৃত হল পুরোপুরি।
আর সেই অবক্ষয়ের সর্বপ্রথম আঘাত পড়লো শিক্ষাব্যবস্থার আঁতুরঘর রাজ্যের বিশ্ববিদ্যালয়গুলির পরিসরে ও শিক্ষা ব্যবস্থার সামগ্রিক পরিকাঠামোতেই। প্রতিটি কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ই হয়ে উঠল ক্যাডার তৈরীর কারখানা। পার্টির তৈরী করে দেওয়া শেখানো বুলির তোতাপাখি হিসেবে গড়ে তোলা হতে থাকল যুবসম্প্রদায়কে। যাদের হাতে পড়ে রইল একটাই লক্ষ্য; পার্টির ভোটব্যাঙ্ক বাড়ানো আর সেই সুযোগে সরকারী চকুরীর প্রসাদ পাওয়া। মৌলিক চেতনার পূর্ণ বিকাশে শিক্ষার আর কোনো ভূমিকাই থাকল না। একদল তাদের মেধার যোগ্যতায় পাড়ি দিতে থাকল রাজ্যের বাইরে। আর একদল ছাত্ররাজনীতির নামে আখের গোছানোর কাজে নিবিষ্ট থাকল। রাজনৈতিক নেতানেত্রীর শেখানো বুলির বাইরে তাদের বুদ্ধিবৃত্তি পুষ্ট হল না আর। যে কোন জাতির পক্ষেই এ এক ভয়ঙ্কর অবস্থার অশনি সংকেত। দুঃখের বিষয় সিপিএম-এর নেতৃত্বের, এই আশনি সংকেত অনুধাবন করার মতো রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ছিল না সেদিন। উল্টে তাঁদের নির্দ্দিষ্ট পরিকল্পনায় ছাত্ররাজনীতিকে গড়ে তোলা হল পার্টির ভোটব্যাঙ্ক বৃদ্ধির দুরন্ত হাতিয়ার হিসেবেই। গোটা রাজ্যের অধিকাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে নিজেদের পতাকার তলায় নিয়ে আসতে পারার বিজয়াল্লসেই তারা তখন মত্ত। সেই সাথে কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে শিক্ষক অধ্যাপক ও শিক্ষাকর্মী নিয়োগে পার্টির প্রতি আনুগত্যই যোগ্যতার প্রথম ও প্রধান মাপকাঠি হয়ে দাঁড়ালো দিনে দিনে। এইরকম নিষ্ছিদ্র বন্দোবস্তের সফল বাস্তবায়নে সিপিএম যখন আনন্দে আত্মহারা তখন তলায় তলায় রাজ্যে বছরের পর বছর বিকলাঙ্গ মানসিকতার প্রজন্ম গড়ে উঠতে থাকল। যাদের কাছে পার্টির পতাকা জড়িয়ে ব্যক্তিগত আখের গোছানোই জীবনের মূলমন্ত্র হয়ে উঠল। উঠল শিক্ষাঙ্গনের রাজনৈতিক প্রাঙ্গণ থেকেই।
তাই গত তিনদশক ধরেই এরাজ্যের শিক্ষাব্যবস্থার মান ক্রমাগত নীচে নামতে নামতে আজকে সিপিএম-এর বংশধর এই তৃণমুলী আমলে এসে তলানীতে ঠেকেছে। বিশ্ববিদ্যালয় আজ আর জ্ঞান বিজ্ঞান চর্চার ক্ষেত্র নয়! সরকারী চাকুরীর চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের অন্যতম আখরা আর সরকারী দলের ভোটব্যাঙ্কের নাটবল্টু উৎপাদনের কারখানা মাত্র। এই পরিসরে মধ্যমেধার সুবিধেভোগী বুদ্ধিজীবিদেরই রমরমা! তাই তারাই নানান ভাবে এই শিক্ষাব্যবস্থার পরিকাঠামোতে যুক্ত হয়ে ক্ষমতার ননী মাখন চাটতে ব্যস্ত! আর বর্তমান শাসকদল সিপিএমের তিনদশকের আখের গোছানোর পরিকল্পনাকে প্রথম তিন মাসেই সফল করে ফেলেছে। তাই বর্তমানে প্রকৃত সৎ ও মেধাবী শিক্ষাব্রতী মানুষদের পক্ষে এই রাজ্যের কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই কাজ করা শুধু অসম্ভবই নয়, নিরাপদও নয়! তাই যঃ পলায়তি সঃ জীবতি!
বস্তুত সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের কংগ্রেসী আমলের নকশাল আন্দোলনকে দমন করার রাজনৈতিক ফয়দাটি পরিপূর্ণ সদ্ব্যব্যহার করেই সিপিএম-এর সাড়ে তিনদশকের রাজত্ব! দেশে মধ্যমেধার রমরমা চললেই ক্ষমতার কেন্দ্রে বসে একটানা রাজত্ব চালানোর সমূহ সুবিধে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের এই মূলসূত্রটি জ্যোতিবসুর নেতৃত্বাধীন পার্টি খুব ভালো করেই জানতো। আর সেই কাজেই রাজ্যের শিক্ষাব্যবস্থার মেরুদণ্ডটি জ্যোতিবসুর আমল থেকেই ভেঙ্গে ফেলা শুরু হয়েছিল খুব দক্ষতার সাথেই। কিন্তু তখন তাঁরা বোঝেননি, তাঁদের সেই অপকর্মের ফলশ্রুতি একদিন কি ভয়ানক হতে পারে। যে ধারার সূত্রপাত তাঁরা করে গেলেন, তা যে কি বিদ্ধংসী সংস্কৃতির জন্ম দিয়ে গেল, আজকে পরিবর্তনের প্রথম চার বছরেই রাজ্যবাসী তা মর্মে মর্মে অনুধাবন করতে পারছেন। এ যেন সন্ত্রাসীদের হাতে পরমাণু বোমার চাবিকাঠি তুলে দেওয়ার মতো ব্যাপার।
তাই আজ যখন ভুতপূর্ব শাসকদলের নেতানেত্রীদেরকে বর্তমান প্রশাসকের দিকে সমালোচনার তর্জনী তুলতে দেখা যায়, রাজ্যবাসী তখন আর সেই তর্জনীকে বিশ্বাস ও ভরসা কোনোটাই করতে পারে না। চূড়ান্ত দুঃখের বিষয় এটাই, আজকে রাজ্যের শিক্ষাব্যবস্থার চূড়ান্ত অবক্ষয় দেখেও ভুতপূর্ব শাসকদলের নেতানেত্রী থেকে একনিষ্ঠ ভক্তদের কাউকেই তা।দের পার্টির এমন ক্ষমাহীন অপকর্মের জন্যেও আত্মসমীক্ষা করতে দেখা যায় না। দেখা যায় না নিজেদের কৃতকর্মের জন্যে সামান্যতম হলেও লজ্জিত হতে। এটাই এ রাজ্যের চরিত্র।