২০০৭ এ আমি এক ধুলোভরা বীরভূম দেখেছি । বাইকে করে যেতে যেতে কালো আকাশ দেখেছি । তা আমার প্রেমিকার কোঁচানো চুলের কালো নয়, সে বনলতার ডাগর চোখের কালো নয় । একটা অঞ্চলে ২৫০ টা ক্রাসার চলছে সারাদিনরাতি । পাথর ভাঙছে । আর হুহু ধুলোয় ভরে যাচ্ছে মাঠ ঘাট প্রান্তর । রাত বারোটায় যখন চাটাইতে বসে ঘুমে দুলছি, দূর গ্রাম থেকে ভেসে আসা ঢিক চ্যাক গান শুনেছি । জিজ্ঞাসা করায় জানতে পেরেছি তাঁবু খাটিয়ে গ্রামের মাঝে চলছে পর্ণগ্রাফি । হাটে ফিয়ে দেখেছি মেয়ে কেনা বেচা পর্যন্ত হয় । শুনলে অবাক হবেন একটা ব্লাউল কিনে দিলে, অথবা একটা সাবান কিনে দিলে ক্রাসার মালিকের সাথে হোটেলে গিয়ে রাত কাটাতে রাজি হয়ে যান আদিবাসী মহিলারা । এমন কি বাইক চড়ালেও রাতবিরেতে অঘোর ঘুমন্ত মরদের পাশ থেকে টেনে ক্ষেতের মাঝে নিয়ে গিয়ে যা খুশী করা যায় ।
তীব্র জলকষ্টে ভুগতে থাকা গ্রামের পর গ্রাম দেখেছি । এক একটা খাদান ১৫০ ফিট, ঝাড়খণ্ড লাগোয়া খাদান গুলো ২০০ ফিট আর পাতকুয়া ৭০ ফিট, ফলে রাতে সব জল খাদানে নেমে যায় । সেখানের জলে এতো কেলিক্যাল যে খাওয়া যায় না । নির্জলা উপবাসি একটা জেলা নাম বীরভূম ।
দেখেছি বোল্ডারম্যান দের গ্রাম । বড় বড় পাথর যেগুলো মেশিনে ভাঙা যায় না, সেগুলো হাতুড়ি দিয়ে ভাঙতে হয় । সেই গ্রাম গুলোয় বহু লোকের চোখ নেই, চোখ যদিবা আছে আমাদের চোখের সাদা অংশটা সেটা তাদের টকটকে লাল । তাদের চোখের বিনিময়ে আমরা দুধ সাদা মজেকের মেঝে করেছি । আকরিয়ামে পুষেছি গোল্ডফিস । লাল নীল সবুজ হলুদ পাথর কুঁচির মাঝে হা হয়ে মুখ লুকিয়েছে নিকষ কালো চোখ ।
যে আদিবাসীরা জঙ্গল থেকে জ্বালানি, মধু, বিভিন্ন ছোট পশু পাখি, শাল পাতা, মহুয়া পেত । সেই সব জঙ্গল কেটে সাফ করে লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে আকাশমণি, সোনাঝুরি, ইউক্যালিপ্টাস । যে গাছের কেবল জ্বালানি কাঠ ছাড়া অন্য কিছু দেওয়ার মুরোদ নেই । বনদপ্তর লাগিয়েছেও ইচ্ছা করে, যাতে ভুমিপুত্র কন্যারা শহরের উপর নির্ভরশীল হয়ে পরে । নিজেদের কোন স্বতন্ত্র অর্থনীতি না থাকে । কিন্তু মনে রাখবেন বন্ধুরা দুর্ভিক্ষের সময় শহর উজার হয়ে গেলেও এই আদিবাসী গ্রাম গুলির কিছু হয়নি তাদের নিজেরদের যাপনের জন্য । সেটাই তাদের থেকে কেড়ে নেওয়া হচ্ছে ।
বীরভূম থেকে আসছেন রবিন সরেন । আমার দাদার মতোই হয় বটে । ২০০৯ থেকে অবৈধ খাদান ক্রাসার বন্ধ করে দিয়েছে ওরা । বহুবার খাদান মালিকরা সুপারি দিয়েছে রবিন দা কে মারতে । বাইকে করে ফেরবার পথে পাথর বোঝাই লরি এগিয়ে এসেছে মুখোমুখি সংঘর্ষে । আঁধার নামার পর গ্রামে ঢুকে রবিন দা কে চিনতে না পেরে বন্দুক উঁচিয়েছে খাদান মালিকের দালালরা । তবু আজও জঙ্গলের এই আদিবাসী নেতা লড়াই ছাড়েননি । তুমি ২০০ বছর বাঁচো । শুনবো বীর-ভুমের গল্প ।
২৭শে জুন, বিকাল ৩।৩০, মহাবোধি হল