রিলায়েন্স ও আদানি গ্রুপকে উদ্ধার করতেই সমঝোতা চুক্তি
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরের প্রথমদিন ভারতের বৃহৎ করপোরেট গ্রুপ রিলায়েন্স ও আদানির সঙ্গে মোট ৪ হাজার ৬০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। চুক্তি অনুসারে, আদানি পাওয়ার লিমিটেড মহেষখালীতে ১৬ শ'মেগাওয়াটের কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র এবং রিলায়েন্স পাওয়ার লিমিটেড এলএনজি ভিত্তিক ৩ হাজার মেগাওয়াটের বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করবে।
বাংলাদেশের বিদ্যুৎ সংকট সমাধানের কথা বলে চুক্তিগুলো করা হলেও খোঁজ-খবর করে ভিন্ন চিত্রই পাওয়া গেল। গ্যাসের জোগানের অভাবে ভারতে রিলায়েন্স যে বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করতে পারেনি, সেই বিদ্যুৎকেন্দ্র বাংলাদেশে স্থাপনের (রিলোকেট) সুযোগ দিয়ে রিলায়েন্সকে উদ্ধার করছে গ্যাস সংকটে ভোগা বাংলাদেশ! আদানির পাওয়ারের সঙ্গে চুক্তির ক্ষেত্রেও একই সন্দেহ রয়েছে। রিলায়েন্স এর সঙ্গে চুক্তির ব্যাপারে ভারতের আন্দন্দবাজার লিখেছে: 'গ্যাসের জোগানের অভাবে ভারতে অন্ধ্র প্রদেশের সামালকোটে রিলায়েন্স পাওয়ার-এর আটকে থাকা প্রস্তাবিত ২৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য কেনা নতুন যন্ত্রপাতিই বসানো হবে বাংলাদেশের ওই কারখানায়। মুকেশ অম্বানির রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রিজেরই অন্ধ্রের ওই প্রকল্পে গ্যাস সরবরাহের কথা ছিল। কিন্তু কৃষ্ণা-গোদাবরী অববাহিকা বা কেজি বেসিনে উৎপাদন তলানিতে ঠেকায় কোনও গ্যাসই দিতে পারেনি তারা।' ( সূত্র: ৭ জুন, ২০১৫, আনন্দবাজার পত্রিকা)
রিলায়েন্স পাওয়ারের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত বিজ্ঞপ্তিতেও বিষয়টি স্বীকার করা হয়েছে:
Reliance Power is proposing to install the equipment procured for Samalkot project, including advanced class 9FA machines supplied by GE, in the proposed project at Bangladesh, under appropriate guarantees from GE and the other equipment suppliers. ( সূত্র: জুন ৬, ২০১৫, মিডিয়া রিলিজ, রিলায়েন্স পাওয়ার লিমিটেড)
গত ৪ জুন এ বিষয়ে ডেইলি স্টার লিখেছে, ২০১৪ সালের অক্টোবর থেকেই রিলায়েন্স পুরনো বিদ্যুৎ কেন্দ্র বাংলাদেশে স্থাপনের অনুমতির জন্য জোর লবিং করে আসছিল।অন্ধ্রপ্রদেশের সামালকোটের জন্য কেনা যন্ত্রপাতি বাংলাদেশে ব্যবহার করাটা তাদের জন্য এত গুরুত্বপূর্ণ যে, তারা গত এপ্রিলে চিঠি লিখেছে জানিয়েছে, বাংলাদেশ অরুণাচলে রিলায়েন্সের ১২০০ মেগাওয়াট কালাই জলবিদ্যুৎ প্রকল্প থেকে যে বিদ্যুৎ কিনতে চায়, সেটা তারা বাংলাদেশকে দেবে, যদি বাংলাদেশ তাদের সামালকোটের বিদ্যুৎ কেন্দ্র বাংলাদেশে স্থানান্তরের অনুমতি দেয়!
Our proposal regarding sale of power from Kalai Hydro Project at Arunachal Pradesh is interlinked with the proposal for 3,000MW gas-fired combined cycle power project in two phases, and may please be considered for combined approval by the government of Bangladesh. (সূত্র: জুন ৪, ২০১৫, দ্য ডেইলি স্টার)
শুধু তাই নয়, রিলায়েন্সের আবদার, এই বিদ্যুৎ কেন্দ্র তাদের বাংলাদেশের নারায়ণগঞ্জের মেঘনাঘাটেই স্থাপন করতে দিতে হবে। মেঘনাঘাট চাই কারণ, এখানে বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের জন্য প্রয়োজনীয় সমস্ত অবকাঠামো যেমন জমি ও জাতীয় গ্রিডের সঙ্গে কানেক্টিভিটি একেবারে প্রস্তুত অবস্থায় আছে। কিন্তু ৩ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য যে বিপুল পরিমাণ গ্যাস লাগবে সেই গ্যাস পাওয়া যাবে কোথায়? রিলায়েন্সের প্রস্তাব, তারা কক্সবাজারের মহেশখালীতে একটি ভাসমান এলএনজি প্ল্যান্ট (এফএসআরইউ) স্থাপন করবে। এলএনজি প্ল্যান্ট থেকে তারা জাতীয় গ্রিডে গ্যাস সর্বরাহ করবে এবং মেঘনাঘাটে বিদ্যমান গ্যাস গ্রিড থেকে গ্যাস নিয়ে বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি চালাবে। মেঘনাঘাটে তারা প্রথমে ২২৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করবে। যার জন্য গ্যাস প্রয়োজন হবে ৩৩ থেকে ৩৯ কোটি ইউনিট (এমএসসিএফ)। এর জন্য প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের জন্য তাদের দিতে হবে ১০.৫৫ সেন্ট বা ৮ টাকা ৪৪ পয়সা। গ্যাসভিত্তিক বৃহৎ বিদ্যুৎ কেন্দ্র হিসেবে এই দরটা অনেক বেশি। এলএনজি থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের খরচ তুলনামূলক বেশি হলেও প্রতিযোগিতামূলক টেন্ডারের মাধ্যমে দর নির্ধারিত হচ্ছে না, সেহেতু এটা নিয়ে প্রশ্ন ওঠাই স্বাভাবিক।
লক্ষণীয় বিষয় হলো, সমঝোতা চুক্তিতে বিদ্যুৎ কেন্দ্র কোথায় স্থাপন করা হবে, তা সুনির্দিষ্ট করে কিছু বলা হয়নি। এর একটা কারণ হতে পারে, মেঘনাঘাটে রিলায়েন্সকে গ্যাস দেওয়ার ব্যাপার পেট্রোবাংলার আপত্তি ও অপারগতা প্রকাশ। গত ১ এপ্রিল ডেইলি অবজারভারে প্রকাশিত 'পেট্রোবাংলা টার্নস ডাউন রিলায়েন্স অফার'শীর্ষক সংবাদ থেকে দেখা যায়, পেট্রোবাংলার বক্তব্য হলো- মহেশখালীর এলএনজি টার্মিনালের গ্যাস মেঘনাঘাটে সরবরাহ করা কঠিন হবে। গ্যাস সরবরাহের জন্য একটি মাত্র লাইন থাকার কারণে এবং সেই লাইনের সীমাবদ্ধতা থাকার কারণে রিলায়েন্স যতটুকু গ্যাস কক্সবাজারে সর্বরাহ করবে, তা পাইপ লাইনের সীমাবদ্ধতার কারণে মেঘনাঘাটে আনা যাবে না, চট্টগ্রামেই ব্যবহার করতে হবে। আমাদের পক্ষে বাখরাবাদ থেকে মেঘনাঘাট বা চট্টগ্রাম থেকে বাখরাবাদে নুতন পাইপ লাইন নির্মাণ করা সম্ভব হবে না। যদি নির্মাণ করা সম্ভবও হয়, তাহলে এর খরচ কে বহন করবে? উল্লেখ্য যে, রাষ্ট্রীয় বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোয় প্রয়োজনীয় গ্যাস সরবরাহ করতে না পারার কারণে এমনিতেই মেঘনাঘাট-ঘোড়াশাল-আশুগঞ্জ-সিদ্ধিরগঞ্জ এলাকায় ১১০০ থেকে ১২০০ মেগাওয়াট গ্যাস কম উৎপাদিত হচ্ছে। (সূত্র: এপ্রিল ১, ২০১৫, ডেইলি অবজারভার)
সমঝোতা চুক্তিতে মেঘনাঘাটের কথা সুনির্দিষ্ট করে বলা না হলেও, গ্যাস সর্বরাহ নিয়ে আশঙ্কাটা রয়েই যাচ্ছে। এক্ষেত্রে আরও যেসব প্রশ্ন ওঠে তা হলো, এলএনজি আমদানি থেকেই যদি গ্যাস সরবরাহ করা হবে, তাহলে রিলায়েন্স ভারতেই সেটা করতে পারল না কেন? কেন বাংলাদেশের মেঘনাঘাটেই তাকে বিদ্যুৎ কেন্দ্র করতে হবে?
রিলায়েন্সের যেমন গ্যাস সংকট, আদানি গ্রুপের তেমনি কয়লা সংকট। কয়লা সংকটের কারণে আদানি পাওয়ার-এর ৩টি বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন বন্ধ থাকার সংবাদ প্রকাশিত হয়েছিল এনডিটিভিতে। খবরটিতে বলা হয়েছিলো- কয়লার সংকটের কারণে আদানি পাওয়ারের মধ্যপ্রদেশের চিনদোয়ারা এবং গুজরাটের দাহেজ ও ভাদ্রেশ্বরে মোট ৬ হাজার ৫০০ মেগাওয়াটের ৩টি বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন স্থগিত আছে। (সূত্র: ডিসেম্বর ২৭, ২০১১, এনডিটিভি)
এই কয়লা সংকটের সুরাহা হয়েছে এরকম কোনও খবর পাওয়া যায়নি।
আমাদের প্রশ্ন হলো, এলএনজি, কয়লা আমদানি করেই যদি বিদ্যুৎ কেন্দ্র বসবে, তাহলে সেটা পিডিবির মালিকানায় প্রতিযোগিতামূলক টেন্ডারের মাধ্যমে হবে না কেন? কেন জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ আইনের আওতায় ভারতীয় কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি করা হলো! দেশে নাকি এখন বিদ্যুৎ সংকট নেই, তাহলে তড়িঘড়ি করে এ ধরনের চুক্তি করার দরকার পড়ল কেন?
পত্রিকায় দেখলাম, বিনা টেন্ডারে বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের যে সুবিধা এতদিন বাংলাদেশের বিদ্যুৎ ব্যাবসায়ীরা পেয়ে এসেছেন, তা ভারতীয় কোম্পানিকে দেওয়ায় নাখোশ হয়েছেন বাংলাদেশের ব্যাবসায়ীরা। নাখোশ হওয়ারই কথা, বিনা টেন্ডারে প্রতিযোগিতাহীনভাবে বেশি দামে বিদ্যুৎ বিক্রি থেকে যে মুনাফা হয়, তার ভাগ অন্যদের দিতে চাইবেন কেন তারা!
মজার ব্যাপার হলো, এতে যে দেশের ও জনগণের ক্ষতি হবে এ কথা এই বিদ্যুৎ ব্যাবসায়ীরা বলছেন না, তারা এর বিপরীতে উত্তর-পূর্ব ভারতে টেন্ডারবিহীন বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের অনুমতি পেলেই সন্তুষ্ট থাকবেন বলে সংবাদ মাধ্যমে জানিয়েছেন তারা! ( সূত্র: জুন ৭, ২০১৫, প্রথম আলো)
আমরা বিনা টেন্ডারে বিশেষ জ্বালানি আইনের আওতায় প্রতিযোগিতাহীনভাবে ভারতের রিলায়েন্স ও আদানি পাওয়ারের সঙ্গে বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের চুক্তি বাতিলের দাবি জানাই।
যে বিদ্যুৎ কেন্দ্রই স্থাপন করা হোক, পিডিবির মালিকানায় আন্তর্জাতিক টেন্ডারের মাধ্যমে যন্ত্রপাতি কিনে তা স্থাপন করতে হবে।