মধ্য আয়ের দেশের বাস্তবতা বাংলাদেশের নেই
অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ
২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ একটি মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হবে। দেশের অর্থনীতির কি উন্নয়ন হবে? দারিদ্র্যতা কত মাত্রায় কমবে? সময়ের স্রোতে এমন অনেক প্রশ্নই এখন ঘুর-পাক খাচ্ছে সবার মনে। এ বিষয়ে গুরুত্বপুর্ণ মতামত দিয়েছেন তেল গ্যাস বিদ্যুৎ বন্দর ও খণিজ সম্পদ রক্ষা জাতীয় কমিটির সদস্য সচিব বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ।
মধ্যআয়, নিম্ন আয়, উচ্চ আয়গুলো তো কিছু নির্দিষ্ট হিসাবের মধ্যে থাকে। মধ্যআয় হচ্ছে সেটি যখন গড়পড়তা অধিকাংশ মানুষের আয় সমানুপাতিক হারে বাড়বে। মোট জাতীয় উৎপাদন বা জিডিপি এবং মাথাপিছু আয়ও বাড়বে। ফলে এক সময় দেশ মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হবে। আমাদের দেশের অর্থনীতির যে গতি, তাতে এমনিতেই এটা মধ্যম আয়ের দিকেই এগোচ্ছে। কিন্তু মধ্যম আয় দিয়ে এটা নিশ্চিত হয় না, যে একটা দেশ মধ্যম আয়ের হলেই মানুষের মৌলিক সব চাহিদা পূরণ হবে, তাদের কর্মসংস্থান হবে, শিক্ষা ও চিকিৎসা ব্যবস্থা নিশ্চিত হবে। আয় বাড়ার পাশাপাশি দেশের নিম্নশ্রেণীর মানুষের স্বাভাবিক ও স্বচ্ছলভাবে বসবাসের জন্য একটা সুন্দর পরিস্থিতি সুনিশ্চিত হবে।
মধ্যম আয়ের দেশ বলতে যা বোঝায় তার অনেক কিছুই আমাদের এখন পর্যন্ত নেই। এখন যে পরিস্থিতিতে চলছে তাতে ২০২১ বা ২২ সালের দিকে দেশটি একটি নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হতে পারে। বার্ষিক গড় প্রবৃদ্ধি যদি ৫ থেকে ৬ শতাংশ অব্যাহত থাকে তা;হলে সম্পদ ও চাকরির সুযোগও বাড়তে থাকবে। তবে মধ্যম আয়ের একটি দেশের অর্থনীতি ও সামগ্রিক সমাজ ব্যবস্থার যে চরিত্র থাকা উচিত বাংলাদেশে তা নেই। আদৌ তা অর্জিত হবে কি-না তা'নিয়েও যথেষ্ট সংশয় রয়েছে। তবে বিভিন্ন ভাবে যা বলা হচ্ছে তা রাজনৈতিক শ্লোগান মাত্র।
তবে এক্ষেত্রে আমাদের লক্ষ্যটা হওয়া উচিৎ ২০২১ সালের মধ্যে দেশের সব মানুষকে শিক্ষার সুযোগ করে দেয়া , তাদের চিকিৎসার অধিকার নিশ্চিত করা, কর্মসংস্থানের অধিকার নিশ্চিত করা এবং মানুষের সম্মানজনক জীবনযাপন পুরোপুরি নিশ্চিত করা। এগুলোই লক্ষ্য হওয়া উচিৎ। মধ্যম আয়ের হিসাব হচ্ছে একটা গড় ধারণা। এর উদহারণ হলো- একজন যদি এক কোটি টাকা আয় কওে, আরেকজন যদি এক হাজার টাকা আয় করে। এটি গড় করলে দু'জনেরই পড়বে ৫০ লাখ ৫০০ টাকা। এখন যে এক হাজার টাকা আয় করে তার মাথাপিছু আয়ও কিন্তু হবে ৫০ লাখ ৫'শ টাকা। এই গড় হিসাবের বাস্তবতা আমাদের দেশে নেই।
বাংলাদেশে ৫ শতাংশের হাতে যে পরিমান বিত্ত জমা হয়েছে সেটা কিন্তু মাথাপিছু আয়ের হিসাবের মধ্যে আসে। এখনো আমরা মাথাপিছু আয় যেটা দেখি বছরে ৮০০ থেকে ৯০০ ডলার। এই আয় দিয়ে কিন্তু শতকার ৫০ ভাগ মানুষের প্রকৃত অবস্থা বোঝা যায় না।
আমার মনে হয় একটা দেশে বৈষম্য যদি বেশি থাকে তাহলে গড় আয় দিয়ে শুধুমাত্র একটা বিভ্রান্তিকর ধারণা তৈরি হতে পারে। কিন্তু প্রকৃত পরিস্থিতি বোঝা যায় না। এটি বুঝতে হলে দেখতে হবে নীচের দশ শতাংশ এবং উপরের দশ শতাংশের প্রকৃত অবস্থাটা কী ? সকল মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণের সবধরনের ব্যবস্থা আছে কি না? সুতরাং মধ্যম আয়ের দেশ কখনো উন্নয়নের প্রধান মাধ্যম হতে পারে না। প্রকৃতপক্ষে জনগণের নিরাপত্তা, তাদের খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা, শিক্ষা এই জাতীয় জায়গাগুলো নিশ্চিত করতে হবে।
এখানে যে সম্পদ আছে। এ দেশের মানুষের যে কর্মক্ষমতা এগুলো যদি আমরা বিবেচনা করি তাতে হিসাবগুলি সহজেই মিলবে না। পরিকল্পিতভাবে অগ্রসর হলে এবং এগুলোকে পরিচর্যা করা হলে এদেশকে আগামি ৫ বছরের মধ্যে লক্ষ্যনীয় অগ্রগতি অর্জন সম্ভব হবে। এ দেশে এখন যে পরিমান দারিদ্র্যতা আছে এ আকারের দারিদ্রতা থাকার কোনো কারণ নেই, ক্ষুধা এভাবে থাকার কোনো কারণ নেই, আমাদের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার মতো খাদ্য বাংলাদেশে উৎপাদিত হয়। বাংলাদেশে তরুণ প্রজন্ম যারা আছে এবং সামাজিকভাবে মানুষের যে উদ্দীপনা আছে সেটাকে ঠিক মতো কাজে লাগাতে পারলে অনেক কিছু করা সম্ভব হতো।
আমাদের দেশে যে পরিমান নিরক্ষরতা আছে মাত্র দু'বছর ঠিকমতো পরিকল্পনা গ্রহণের মাধ্যমে এটাকে দুর করা সম্ভব। চিকিৎসাখাতে একটা বড় ধরনের পরিবর্তন সম্ভব যদি সরকার চিকিৎসা খাতকে বাণিজ্যিককরণের হাত থেকে রক্ষা করে। তা'হলে দেখা যেতে পারে তরুণ প্রজন্মের যারা ডাক্তার হচ্ছেন তারা উজ্জ্বীবিত হবে।
দেশে যে পরিমান প্রাকৃতিক সম্পদ আছে এগুলো বন্টনে যদি দেশীয় প্রতিষ্ঠান করা যায় তাহলে আগামি ১০ বছরের মধ্যে এ দেশে জ্বালানি নিরাপত্তাও নিশ্চিত হবে। এখানে সমস্যাটা সম্পদের না, দক্ষ জনশক্তিরও না, সমস্যা হচ্ছে সম্পদের উপর কিছু গোষ্ঠীর আধিপত্য বিস্তার। প্রচুর পরিমানে রেমিটেন্স আসছে। এখন প্রতিমাসে আমাদের দেশে যে পরিমান বিদেশী সাহায্য আসছে তা প্রতি দেড়মাসের রেমিটেন্সের সমান। তা'হলে বিদেশী সাহায্য, ঋণ- এগুলো নিয়ে এতো হাহাকার করার কি আছে। গার্মেন্টস শ্রমিকরা নিয়ে আসছে বৈদেশিক মুদ্রা। এসব বৈদেশিক মুদ্রার ওপর কর্তৃত্বটা কার।কেউ কেউ বিদেশে ডলার পাচার করছে। একসময় সরকার বলবে টাকা নেই, বিদেশী সাহায্য লাগবে।
আসলে দেশে যত বিদেশী ঋণ আসে আমরা ততবেশি জালের মধ্যে পড়ি। এই শৃঙ্খলটা তৈরি করে কিছু লোকের লাভ হয়। তারা বিভিন্ন দেশ সফর করতে পারে। কনসালটেন্সি ফি পায় তারা। কিন্তু পুরো দেশ ঋণের জালে আটকা পড়ে। আমাদের সম্পদ জনগণের কাজে লাগানোর জন্য যে ধরনের রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক নীতি দরকার তা নেই। সেটা থাকলে ৫ থেকে ৭ বছরে বড় ধরনের পরিবর্তন সম্ভব এবং দশ বছরের মধ্যে শুধু মধ্যম আয় নয় উন্নত দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব।
http://www.risingbd.com/printnews.php?nssl=3554