সরকারি ও একজন বিচারপতির পৈতৃক জমি জবরদখল করে নির্মাণাধীন খুলনার দৌলতপুর থানা আওয়ামী লীগের কার্যালয় ভবনটি উচ্ছেদ করা যায়নি। বৃহস্পতিবার থেকে কয়েক দফা চেষ্টা করেও দলীয় নেতা-কর্মীদের প্রবল বাধার মুখে উচ্ছেদ কার্যক্রম থেকে পুলিশ-প্রশাসনকে পিছু হটতে হয়েছে। এ কার্যালয় ভবনটি ৭২ ঘণ্টার মধ্যে উচ্ছেদের নির্দেশ রয়েছে উচ্চ আদালতের। ২৮ মে উচ্চ আদালতের ওই আদেশটি খুলনা জেলা প্রশাসনের হাতে আসে। গতকাল উচ্চ আদালতের দেওয়া ৭২ ঘণ্টার সময়সীমা পার হয়েছে।
প্রসঙ্গত, সড়ক ও জনপথ বিভাগের প্রায় ২ শতাংশ ও একজন বিচারপতির পৈতৃক ১ শতাংশ জমি জবরদখল করে আলোচিত বহুতল বিশিষ্ট আওয়ামী লীগ দলীয় কার্যালয়টি নির্মাণ করা হচ্ছে। কিন্তু দুই পক্ষের কারও কাছ থেকেই জমি ব্যবহারের বন্দোবস্ত বা অনুমতি নেওয়া হয়নি। সরেজমিন জানা যায়, উচ্চ আদালতের নির্দেশ বাস্তবায়ন করতে গতকাল সকালে স্থানীয় প্রশাসন বিপুলসংখ্যক পুলিশ নিয়ে পুনরায় উচ্ছেদ অভিযানে গেলে দলীয় নেতা-কর্মীরা মাথায় সাদা কাপড় বেঁধে প্রতিরোধে নামেন। সেই সঙ্গে খুলনা-যশোর মহাসড়ক অবরোধ করে যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দেন। প্রায় তিন ঘণ্টা যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকার পর পুলিশ কর্তাদের অনুরোধে দুই লেনের সড়কের একটি লেন যানবাহন চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। গতকাল দুপুরে সরেজমিন ঘটনাস্থলে একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে বিপুলসংখ্যক পুলিশ অবস্থান করতে দেখা গেছে। পাশাপাশি নির্মাণাধীন কার্যালয় ঘিরে অবস্থান নিয়ে আছেন দলীয় নেতা-কর্মীরা। তারা সেখানে দুপুরের খাবার রান্না করে খেয়েছেন।
জানা যায়, খুলনা মহানগরীর গুরুত্বপূর্ণ দৌলতপুর বেবিস্ট্যান্ডের কাছে সড়ক ও জনপথ বিভাগের প্রায় ২ শতাংশ ও উচ্চ আদালতের একজন বিচারপতির ১ শতাংশ জমি দখল করে দৌলতপুর থানা আওয়ামী লীগের কার্যালয় ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে। ২৬ মার্চ সাবেক প্রতিমন্ত্রী বেগম মন্নুজান সুফিয়ান এমপি কার্যালয় ভবন নির্মাণ কাজের উদ্বোধন করেন। এ জবরদখলের বিরুদ্ধে হিউম্যান রাইটস সোসাইটি নামের একটি সংগঠন ২৫ মে কার্যালয় ভবনটি অপসারণ চেয়ে হাইকোর্টে রিট করে। এতে যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের সচিব, স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাসহ ১৩ জনকে বিবাদী করা হয়। হাইকোর্ট ৭২ ঘণ্টার মধ্যে সড়ক ও জনপথ বিভাগের জমি থেকে দলীয় কার্যালয় ভবন অপসারণের নির্দেশ দেন। একই সঙ্গে আজ (৩১ মে) উচ্ছেদ বিষয়ে কী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, তার প্রতিবেদন জমা দিতেও বলা হয়েছে আদেশে। উচ্চ আদালতের ওই নির্দেশ ২৮ মে খুলনা জেলা প্রশাসনের হাতে আসে। ওই দিনই খুলনার অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট (এডিএম) অজিয়ার রহমানের নেতৃত্বে মহানগর পুলিশের একটি দল উচ্ছেদ অভিযানে নামে। তারা কার্যালয় ভবনের একাংশ ভাঙতে শুরু করলে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। দলীয় নেতা-কর্মীরা কার্যালয় ভবন ঘিরে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ প্রদর্শনসহ কয়েক দফা সড়ক অবরোধও করেন। বাধ্য হয়ে প্রশাসনকে পিছু হটতে হয়েছে। গতকাল পুনরায় আলোচিত কার্যালয় ভবন উচ্ছেদ করতে পুলিশ-প্রশাসন উচ্ছেদ সরঞ্জাম নিয়ে ঘটনাস্থলে আসে। কিন্তু বাধার মুখে তারা উচ্ছেদ করতে পারেনি। এ অভিযানে নেতৃত্বদানকারী নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. ফরিদ হোসেন গতকাল দুপুরে ঘটনাস্থলে বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, 'ব্যক্তিমালিকানার যেটুকু জমির ওপর কংক্রিটের অবকাঠামো নির্মাণ করা হয়েছিল তা অপসারণ করা হয়েছে। এখন বাকি আছে সড়ক ও জনপথ বিভাগের জমির ওপর করা ভবনের কংক্রিটের অবকাঠমো। এটাও আমরা অপসারণের চেষ্ট চালিয়ে যাচ্ছি।'তবে গতকাল দুপুরে নিজ বাড়িতে আলাপকালে বিচারপতির চাচা মো. ইমদাদুল হক বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, তাদের বাড়ির প্রায় ১ শতাংশ জমি জবরদখল করে দলীয় কার্যালয় নির্মাণ করা হয়েছে। প্রশাসন গত দুই দিনে সে জমির উপরিভাগ থেকে স্থাপনা ভেঙে সরিয়ে ফাঁকা করে দিয়েছে। কিন্তু বেসমেন্ট (ভিত) এখনো রয়ে গেছে। ফলে যে কোনো সময় ওই ভিতের ওপর আবারও নতুন করে ভবন নির্মাণ হতে পারে এমন আশঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিচারপতির কয়েক আত্মীয় বলেন, উচ্ছেদ অভিযানের পর থেকে ওই পরিবারটি স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের হুমকির মুখে রয়েছে। এদিকে খুলনার পুলিশ-প্রশাসন বিচারপতির আত্মীয়দের সঙ্গে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের সমঝোতার জন্য মহানগর আওয়ামী লীগের একজন শীর্ষ নেতার বাড়িতে শুক্রবার রাতে মধ্যস্থতা বৈঠক ডাকে। কিন্তু বৈঠকে পুলিশ ও আওয়ামী লীগ নেতারা উপস্থিত হলেও বিচারপতির আত্মীয়রা যাননি। উদ্ভূত পরিস্থিতি সম্পর্কে দৌলতপুর থানা আওয়ামাী লীগের সাধারণ সম্পাদক শহীদুল ইসলাম বন্দ মুঠোফোনে বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বিচারপতির বড় ভাইয়ের দেখিয়ে দেওয়া সীমানার মধ্যেই দলীয় কার্যালয়ের ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। একই সঙ্গে সড়ক ও জনপথ বিভাগের খুলনার কয়েক কর্মকর্তা সরেজমিন জমি মেপে বুঝিয়ে দেওয়ার পর সেখানে পাকা ভবন নির্মাণ শুরু হয়। এখন একটি মানবাধিকার সংস্থার মাধ্যমে আইনি জটিলতার সৃষ্টি করে পরিস্থিতি উত্তপ্ত করা হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, কার্যালয় ভবন নির্মাণের জন্য সরকারি জমিটুকু বন্দোবস্ত পেতে ইতিমধ্যে সড়ক ও জনপথ বিভাগে আবেদন করা হয়েছে, যা প্রক্রিয়াধীন। তবে সড়ক ও জনপথ বিভাগের খুলনা কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী অলিউল হোসেন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, যে জমির ওপর দলীয় কার্যালয় ভবন নির্মাণ করা হয়েছে তার অধিকাংশের মালিকানা সড়ক ও জনপথ বিভাগের। কিন্তু ওই জমি ব্যবহার বা তার ওপর ভবন নির্মাণের জন্য কাউকে কোনো প্রকার অনুমতি বা বন্দোবস্ত দেওয়া হয়নি। এ রকম বন্দোবস্ত দেওয়ার বিধানও সড়ক ও জনপথ বিভাগের নেই।
http://www.bd-pratidin.com/lead-news/2015/05/31/84561