সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ইউটিউবে দলের সিনিয়র নেতা ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ ও সাবেক ছাত্রদল নেতা বজলুল করীম চৌধুরী আবেদের ফোনালাপ নিয়ে তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে বিএনপিতে। দলের অধিকাংশ নেতা-কর্মীই মনে করেন, জিয়ার আদর্শ থেকে বিএনপি আজ লক্ষ্যচ্যুত। বিএনপিকে নতুনভাবে ঘুরে দাঁড়াতে হবে। জিয়ার ১৯ দফাকে সামনে রেখে দলে আমূল সংস্কার আনতে হবে। এ ছাড়া জামায়াত বর্জন প্রশ্নেও সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় এসেছে।
ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ ও আবেদের ফোনালাপেও জামায়াত ছাড়ার প্রসঙ্গটি উঠে এসেছে। বিএনপির নেতা-কর্মীরা মনে করেন, বাংলাদেশকে একটি সমৃদ্ধশালী, উন্নত গণতন্ত্রের দেশ হিসেবে গড়ে তুলতেই সময়োপযোগী ১৯ দফা কর্মসূচি দিয়েছিলেন জিয়াউর রহমান। সময়ের প্রবাহে ওই ১৯ দফা থেকে অনেক দূরে সরে এসেছে বিএনপি। কেন্দ্রীয় পর্যায়ের অনেক নেতার মনেও নেই সেই ১৯ দফা। চলমান দলীয় রাজনীতির প্রতি নেতা-কর্মীরা দৃশ্যত নিষ্ঠাবান থাকলেও দলের পক্ষ থেকে ১৯ দফার বিষয়ে কোনো চর্চা না থাকায় দিন দিন সেই প্রতিষ্ঠাকালীন মৌলিক বিষয়গুলো কার্যত ভুলতে বসেছেন নেতা-কর্মীরা।
এ কারণেই দুই বছরে ফলাফলশূন্য আন্দোলনে মামলা-হামলা, গুম, খুন কিংবা গ্রেফতারের খড়গ নেমে এসেছে দলের বহু নেতা-কর্মীর ওপর। দলের সিনিয়র নেতাদের বড় একটি অংশই মনে করেন, বর্তমান সরকারের দুই মেয়াদে রাজনৈতিকভাবেও বিএনপি অনেক ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছে। যার খেসারত দিতে হচ্ছে নেতা-কর্মীদের।
এ ছাড়া ঢাকা সফরকালে ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির সঙ্গে খালেদা জিয়ার সাক্ষাৎ না করা, বিগত ৫ জানুয়ারি সংসদ নির্বাচন বয়কট করা, নির্বাচনের আগে প্রধানমন্ত্রীর ফোনে বিএনপি চেয়ারপারসনের সাড়া না দেওয়া, পুত্রশোকে কাতর খালেদাকে সমবেদনা জানাতে যাওয়া প্রধানমন্ত্রীকে গুলশান কার্যালয়ের সামনে থেকে ফিরিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্তও চরম ভুল ছিল।
এ প্রসঙ্গে গতকাল রাতে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জেনারেল (অব.) মাহবুবুর রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, জিয়ার আদর্শ থেকে বিএনপি সরে গেছে- এটা সম্পূর্ণ না হলেও অনেকাংশে ঠিক। জিয়া দুর্নীতিমুক্ত, কলুষমুক্ত রাষ্ট্র গড়েছেন। কিন্তু বর্তমান বিএনপিতে এর অভাব রয়েছে। তার সততা, নিষ্ঠাও আজ নেতা-কর্মীদের মধ্যে অনুপস্থিত। তার যে মন্ত্রিসভা ছিল, সে রকম মন্ত্রিসভা আর কেউই করতে পারেননি। এখন আমাদের উচিত হবে, জিয়ার ১৯ দফাকে সামনে রেখে এগিয়ে যাওয়া।
দলের যুগ্ম-মহাসচিব মো. শাহজাহান বলেন, যত বাধাই আসুক, বিএনপি তার লক্ষ্য থেকে সরবে না। সময়ের বাঁকে বাঁকে দলে কিছুটা বিচ্যুতি এলেও শহীদ জিয়ার মূল দর্শন থেকে আমরা দূরে সরে যাইনি। নইলে ইতিহাসে নজীরবিহীন গুম, খুন, হামলা-মামলা, দমন-পীড়নের পরও বিএনপি আজ টিকে আছে কীভাবে? এখন মূল কাজ হচ্ছে, দলের মূল ধারা ঠিক রেখে বিএনপিকে নতুনভাবে সাজানো। ১৯ দফার আলোকে বিএনপিকে জাতির সামনে তুলে ধরা।
ইউটিউবের সেই আলোচিত বক্তব্য : গত ৮ মে দুপুরে ব্যারিস্টার মওদুদের সঙ্গে কথা হয় বজলুল করীম চৌধুরী আবেদের। এ ফোনালাপটি গতকাল পর্যন্ত ৬৮২ জন শেয়ার করে। ২ মিনিট ৮ সেকেন্ডের এ বক্তব্যে ব্যারিস্টার মওদুদ ও বজলুল করীম চৌধুরী আবেদের মধ্যে কুশলবিনিময় ছাড়াও রাজনৈতিক বিষয়ে কথাবার্তা হয়। কুশলবিনিময়ের একপর্যায়ে ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ বলেন, এই বিএনপি দিয়ে হবে না। জিয়াউর রহমানের বিএনপি যদি করতে পার- এ সময় ছাত্রনেতা আবেদ বলেন, স্যার আপনি তো আমার মনের ক্ষুধা জানেন। আপনারা যেভাবে রাজনীতি করে আসছেন, আমি সেভাবেই রাজনীতি করতে চাচ্ছি। আমরা অসাম্প্রদায়িক রাজনীতিতে বিশ্বাস করি। ধর্ম আমি কতটুকু করব না করব, তা আমার ব্যক্তিগত বিষয়। যে যার ধর্মে বিশ্বাস করে, তাদের সম্মান করে রাজনীতি করতে চাই।
এ সময় মওদুদ বলেন, অবশ্যই, অবশ্যই। সাবেক এই ছাত্রনেতা আরও বলেন, স্যার আপনাকে আগেই বলেছিলাম, জামায়াতের ব্যাপারে বিএনপি যতদিন সিদ্ধান্ত নিতে না পারবে, ততদিন বিশ্বের দরবারে বলেন, দেশে বলেন- কোথাও বিএনপি তার পজিটিভ ইমেজ তুলে ধরতে পারবে না। এ সময় মওদুদ বলেন, ঠিক কথা, ঠিক কথা। তুমি জানো, আমিও এটাই বিশ্বাস করি।
এদিকে সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের ৩৪তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে গত বৃহস্পতিবার রাজধানীতে এক আলোচনা সভায় খালেদা জিয়ার সামনেই আলোচকরাও বিএনপিকে নিয়ে সমালোচনা করেন। তাদের ভাষায়, জিয়াউর রহমানের রেখে যাওয়া আদর্শ বিএনপি ধরে রাখতে পারেনি। এ জন্য দলের নেতা-কর্মী সবারই লজ্জিত হওয়া উচিত। দলে যদি জিয়ার আদর্শ বাস্তবায়ন করা যায় তাহলেই কেবল কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছানো সম্ভব। অন্যথায় অসম্ভব।
বিকল্পধারা সভাপতি অধ্যাপক এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরী বলেন, দেশ ও জনগণের ভাগ্য পরিবর্তন করতে হলে আগে নিজেদের পরিবর্তন হতে হবে। সেক্ষেত্রে প্রত্যেককে জিয়াউর রহমানের মতো হয়ে উঠতে হবে। যদি ভুল করেন, তাহলে ইতিহাস কাউকেই ক্ষমা করবে না। বিএনপি নেতা-কর্মীদের উদ্দেশ করে সাবেক এই রাষ্ট্রপতি বলেন, দুই দিনের জন্য জিয়াউর রহমানকে স্মরণ করা ভুল ও আত্মহত্যার শামিল। দলকে ভালোবাসতে হবে। যার যার ভুল যদি সংশোধন করি তবে জাতীয়তাবাদী শক্তি আবার ঘুরে দাঁড়াবে। বিএনপিতে আত্ম-অনুসন্ধান প্রয়োজন বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আ স ম হান্নান শাহ বলেন, সামরিক এবং রাজনৈতিক উভয় ক্ষেত্রেই জিয়া ছিলেন অনুকরণীয়। কিন্তু দুর্ভাগ্য যে, জিয়ার রেখে যাওয়া আদর্শ ধরে রাখতে পারেনি। এ জন্য নেতা-কর্মীদের কারও কারও লজ্জা হওয়া উচিত। দলে যদি জিয়ার আদর্শ বাস্তবায়ন করা যায় তাহলেই কেবল কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছানো সম্ভব। চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ব্যারিস্টার শাহজাহান ওমর খালেদা জিয়াকে উদ্দেশ করে বলেন, জিয়াউর রহমান জোট গঠন করেছিলেন। ওই সময় তার সঙ্গে যারা জোটে ছিলেন তাদের বিএনপিতে যোগ দিতে বলেছিলেন। সেই সময় আবদুল মান্নান ভূঁইয়া, কর্নেল আকবরসহ অনেকে বিএনপিতে যোগ দেন। তাই আমি ম্যাডামকে বলব, এখন ২০ দলের আর প্রয়োজন নেই। আপনি তাদের বলেন, তোমরা বিএনপিতে চলে আসো। যারা না আসবে তারা যুগপৎ আন্দোলন করবে।
বিএনপির সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, বিএনপিতে ঘুমন্ত স্থায়ী ও নির্বাহী কমিটি রয়েছে। এ সময় ছাত্রদলের নেতা-কর্মীরা হাততালি দিয়ে তাকে সমর্থন জানান। ক্ষুব্ধ হয়ে তিনি ছাত্রদলের উদ্দেশে বলেন, তোমরাও কিছু করতে পার না। পহেলা বৈশাখের ঘটনায় তোমরা কোথায় ছিলে। জাফরুল্লাহ বলেন, ঈদের পর ১০ দিনের মধ্যে নির্বাচনের মাধ্যমে সব কমিটি পুনর্গঠন করতে হবে। তৃণমূলের ভোটে যাকে নেতা বানাবে সে-ই হবে নেতা। এক ব্যক্তি যাতে একাধিক পদে না আসতে পারে সেদিকে নজর দিতে হবে।
http://www.bd-pratidin.com/first-page/2015/05/30/84335