সাইফুল্লাহ মনসুর <sanapoti1@gmail.com>
বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি ও আইএমএফ শর্তের বেড়াজালে পরিকল্পিতভাবে দেশীয় শিল্প ধ্বংস করে জনগণের জীবনযাত্রাকে কঠিন করা হচ্ছে কেন?
গ্যাস ও বিদ্যুতের নতুন দাম নির্ধারণ করেছে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। চলতি ২০১৫ সালের জানুয়ারি মাসে শেষ হওয়া কথিত 'গণশুনানি'র ভিত্তিতে এই দাম নির্ধারণ করা হয়েছে। তবে নতুন দাম কবে ঘোষণা করা হবে তা এখনো ঠিক হয়নি। দাম বৃদ্ধির গণশুনানির পর রায় দিতে ৯০ দিনের যে বাধ্যবাধকতা রয়েছে সে অনুযায়ী বিদ্যুতের দাম ৭ জুন-২০১৫ এবং গ্যাসের দাম ১৮ জুন-২০১৫ ঈসায়ী তারিখের মধ্যে ঘোষণা করার কথা। এ হিসেবে আগামী জুন (২০১৫) মাসেই গ্যাস ও বিদ্যুতের নতুন দাম ঘোষণা করা হতে পারে।
জানা গেছে, তরল জ্বালানিভিত্তিক কুইক রেন্টাল, রেন্টাল ও বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের দায় নিয়ে বিপাকে পড়েছে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। এসব বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য পিডিবি'র প্রতি মাসে লোকসান হচ্ছে গড়ে ৬০০ কোটি টাকা।
পিডিবি'র একটি সূত্র জানিয়েছে, প্রতি মাসে গড়ে ৬০০ কোটি টাকা হিসাবে বছরে নিট লোকসান হচ্ছে সাত হাজার ২০০ কোটি টাকা, যার পুরো দায়ই পিডিবি'র উপর চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে। বলা হচ্ছে, সরকার বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি দিচ্ছে। অথচ বাস্তবতা হচ্ছেÑ যে অর্থ সরকার বিদ্যুৎ খাতের জন্য ছাড় করছে তার পুরোটাই দেয়া হচ্ছে ঋণ হিসেবে। এতে রাষ্ট্রীয় এ প্রতিষ্ঠানটির দায় বেড়ে চলছে। এ পরিস্থিতিতে পিডিবি'র আর্থিক সক্ষমতা ভেঙে যাচ্ছে।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, বর্তমান বিশ্বে জ্বালানি তেলের দাম বাড়েনি। কিন্তু এরপরও বিদ্যুতের দাম কেন বাড়ছে তা বোধগম্য নয়। সাশ্রয়ী জ্বালানির নিশ্চয়তা করতে না পারলে দাম বৃদ্ধির চাপ কমবে না। গ্যাস ও কয়লা পুড়িয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে গড়ে এখনো দুই থেকে আড়াই টাকা ব্যয় হচ্ছে। কিন্তু তেল পুড়িয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে ২০ টাকা পর্যন্ত ব্যয় হচ্ছে। এতে গড় বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় বেড়ে চলছে। ফলে ব্যয় নির্বাহের অজুহাতেই বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হচ্ছে। তেলভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের সিদ্ধান্ত ছিল সাময়িক সময়ের জন্য। কিন্তু সরকারের মধ্যমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন না হওয়ায় স্বল্পমেয়াদি কুইক রেন্টালই এখন দীর্ঘমেয়াদি রূপ নিচ্ছে। এটার ফলেই বেড়ে যাচ্ছে ভর্তুকি। সরকারের মধ্যমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের জন্য আরো আন্তরিক হতে হবে। দেশী হোক আর আমদানি করে হোক যেকোনো উপায়ে গ্যাস ও কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উপাদন বাড়াতে হবে। তাহলে গড় উৎপাদন ব্যয় কমবে।
মূলত, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) শর্তের ষোলকলা পূর্ণ করতে দফায় দফায় বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দাম বাড়ার রেকর্ড গড়েছে মহাজোট সরকার। কঠিন শর্তের বেড়াজালে জড়িয়ে মাত্র ৯৮ কোটি ৭০ লাখ ডলার ঋণ পেতেই সপ্তমবারের মতো বাড়ানো হয় বিদ্যুতের দাম। আর অষ্টমবারের মতো বড়ানোর প্রক্রিয়া চূড়ান্ত হয়ে আছে; শুধু ঘোষণা বাকি।
বলাবাহুল্য, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি তেলের উচ্চমূল্য, ব্যাংক ঋণের সুদের উচ্চহার এবং মূল্যস্ফীতির কারণে সামষ্টিক অর্থনীতি বর্তমানে অনেক চাপের মুখে রয়েছে। এ অবস্থায় আবারো বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হলে তা শিল্পায়ন, রপ্তানিমুখী শিল্প, কৃষি, শিক্ষা, চিকিৎসাসহ সামগ্রিক অর্থনীতির উপর 'বিরূপ প্রভাব'ফেলবে।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশের শিল্পগুলোর মধ্যে পোশাকশিল্পই এখন প্রধান হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই পোশাকশিল্প প্রায় সবটাই বিদ্যুতের সঠিক সরবরাহ এবং যৌক্তিক মূল্যের উপর নির্ভরশীল। একদিকে বিদ্যুতের অভাব, অন্যদিকে মূল্যবৃদ্ধি এ শিল্পকে ভয়াবহ ক্ষতির সম্মুখীন করতে পারে। সেই সঙ্গে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পগুলো বিপদে পড়তে পারে। শুধু তাই নয়, বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি বিনিয়োগকারীদের চরমভাবে নিরুৎসাহিত করে চলেছে।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, আবারো বিদ্যুতের দাম বাড়ানো প্রসঙ্গে পর্যবেক্ষকমহল বিরূপ মন্তব্য করেছে। তাদের অভিযোগ- সরকার এমনিতেই বিদ্যুৎ দিতে পারছে না; তার উপর দফায় দফায় বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর মাধ্যমে সরকারই চাইছে দেশীয় শিল্প ধ্বংস হয়ে যাক। আর এ সুযোগে দেশীয় শিল্প দখলে করে নেয়ার চেষ্টা করেছে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত। সরকারের মধ্যে ঘাপটি মেরে থাকা কিছু লোক দেশীয় শিল্প ধ্বংসের চক্রান্ত করছে। তারা পরিকল্পিতভাবে নানা সমস্যা সৃষ্টি করার কারণে দেশীয় শিল্প উদ্যোক্তারা বিপাকে পড়েছে। একদিকে বিপুল পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করে লোকসানের ঘানি টানছে; অন্যদিকে নিত্য নতুন সমস্যার মুখোমুখি হয়ে শিল্পকে টিকিয়ে রাখার জন্য প্রাণান্তকর চেষ্টা করতে হচ্ছে। বিদ্যুতের দাম সহনীয় পর্যায় না থাকলে এদেশে শিল্প থাকবে না, শ্রমিকের কর্মসংস্থান থাকবে না; ফলে বাহিরের দেশগুলো আমাদের শিল্পের স্থান দখল করে নিবে।
অভিযোগ উঠেছে, সরকার কৃত্রিমভাবে গ্যাস সঙ্কট সৃষ্টি করে বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে মুনাফা বিদেশী কোম্পানীর হাতে তুলে দিচ্ছে ।
পর্যবেক্ষক মহল আরো মন্তব্য করেছে, বর্তমান সরকার জ্বালানী উপদেষ্টা ড. তৌফিক-ই এলাহী চৌধুরীকে বিদ্যুৎ খাতকে খুন করে দাফন করার লাইন্সেস দিয়েছে! দেশী প্রতিষ্ঠান বাপেক্সকে গ্যাস উত্তোলনের জন্য স্বাধীনতা দেয়া হলে দৈনিক ৬০/৭০ মিলিয়ন ঘন ফুট গ্যাস উত্তোলন করা যেত; যাতে করে বিদ্যুৎ উৎপাদ সহজ হতো। তার বিপরীতে সরকার রেন্টাল-কুইকরেন্টালের মতো বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রস্থাপনের মাধ্যমে বিদেশীদের হাতে অতিরিক্ত মুনাফা তুলে দিচ্ছে। ১০ শতাংশ বিদ্যুতের দাম বাড়লে দ্রব্যমূল্য ৩০% বৃদ্ধি পেয়ে জনগণের উপর মারাত্মক প্রভাব ফেলবে।
অথচ দেশের দীর্ঘমেয়াদী বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রগুলোর যথাযথ সংস্কার ও নতুন কেন্দ্র স্থাপন করা গেলে স্বল্প মূল্যে প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব হতো। এতে সরকারের ভর্তুকির পরিমাণ হ্রাস পেত। কিন্তু এ ক্ষেত্রে যথাযথ উদ্যোগ নেয়া হয়নি।
সরকারের এধরনের কর্মকা-ের ফলাফলে দ্রব্যমূল্য, পরিবহন ব্যয়সহ একদিকে জনগণের জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি পাচ্ছে, অন্যদিকে সমস্ত উৎপাদনী খাতের উপরে মারাত্মক কুপ্রভাব ফেলছে। সরকারের এই ধরনের গণবিরোধী তৎপরতা যেকোনো মূল্যে প্রতিহত করা দরকার। এ ব্যাপারে জনগণকেই এগিয়ে আসতে হবে।
উল্লেখ্য, সরকার বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর আগে, বহু পুরাতন রোগ- কথিত 'সিস্টেম লস'কমনোর পদক্ষেপ নিতে হবে কার্যকরভাবে। বন্ধ করতে হবে সিস্টেম লসের নামে বিদ্যুৎ চুরির কারসাজি। বন্ধ করতে হবে চুরি করা বিদ্যুতের দাম ভোক্তাদের ঘাড়ে চাপানো।