"... ১৯০৫ সালের ১৬ অক্টোবর কার্যকরী হওয়ার দিন থেকে কলকাতায় হিন্দু উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণী বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে নানামুখী কর্মসূচী গ্রহণ করে। এই সময়ে এই আন্দোলনের পুরোভাগে এসে দাঁড়ান কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। রবীন্দ্রনাথ তখন কবি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। সামাজিক মর্যাদায় জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবার কলকাতা তথা বাংলার হিন্দু উচ্চ ও মধ্যবিত্তের সংস্কৃতির জগতের প্রধান পাদপীঠ। অর্থনৈতিকভাবে এই পরিবার জমিদারকুলের শিরোমণি। ফলে খুবই স্বাভাবিকভাবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অবস্থান ছিল কলকাতা কেন্দ্রীক হিন্দু সংস্কৃতির নেতৃত্বের আসনে। সামাজিক শ্রেণীগত অবস্থানের কারণেই রবীন্দ্রনাথ ঝাঁপিয়ে পড়েন বঙ্গভঙ্গ বিরোধী তথা বাঙালি মুসলিম বিরোধী আন্দোলনে। এরই চরম বহি:প্রকাশ "শিবাজী উৎসব" কবিতা রচনা ও প্রকাশ।
... উনিশ শতকের আশির দশকে হিন্দুদের গো-রক্ষা আন্দোলন প্রবল আকার ধারণ করে। দয়ানন্দ স্বরস্বতীর 'গোকরুণানিধি' প্রকাশিত হয় ১৮৮১ সালে। ১৮৮২ সালে এই সংগঠনের জন্য কলকাতা থেকে সংগৃহীত হয় ছয়-সাত লক্ষ টাকা। এটা বলাই বাহুল্য যে কলকাতা থেকে এই বিপুল অর্থের যোগান দিয়েছিল হিন্দু জমিদার ও মধ্যবিত্ত শ্রেণী। দয়ানন্দ স্বরস্বতীর আর্য সমাজ ও গো-রক্ষা আন্দোলন বাংলা এবং সর্বভারতীয় পর্যায়ে হিন্দু-মুসলিম সম্পর্কের অবনতি ঘটায়। প্রত্যক্ষ রাজনৈতিক উদ্দেশ্য না থাকলেও সে সময়ে দেশে কয়েকটি গুপ্ত সমিতি গড়ে উঠে। এইরূপ একটি সংগঠন হলো জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং রাজনারায়ণ বসু প্রতিষ্ঠিত 'সঞ্জীবনী সভা'। ১৮৮৬ সালে রাজনারায়ণ বসুর প্রতিষ্ঠিত এই সংগঠন হিন্দু ধর্মের গৌরব পুনরুদ্ধারে নিবেদিত ছিল। এই সংগঠনের কর্মকান্ডে বাংলার মুসলিম সমাজ সম্পর্কে কোনো ইতিবাচক বক্তব্য স্থান পায়নি। বাংলা ও ভারতবর্ষের ইতিহাসে মুসলমানদের অবদান এবং সমাজে তাদের বাস্তব উপস্থিতি এই সংগঠন উপলব্ধি করতে পারেনি। এই সংগঠনের সাথে জড়িত ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। বস্তুত উনিশ শতকের হিন্দু পুনরুজ্জীবনবাদী আন্দোলনে আন্দোলিত ছিল জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবার।
... হেমলতা দেবী প্রণীত গ্রন্থ 'ভারতবর্ষের ইতিহাস' রবীন্দ্রনাথ সমালোচনা করেন বাংলা ১৩০৫ সালের ভারতী পত্রিকার জৈষ্ঠ্য সংখ্যায়। এই গ্রন্থ সমালোচনার অনুষঙ্গে ভারতে মুসলিম ইতিহাস সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টিভঙ্গির খানিকটা পরিচয় পাওয়া যায়। লেখিকা হেমলতা দেবী সম্ভবত তার ইতিহাস গ্রন্থে প্রামাণ্য তথ্যের ভিত্তিতে বস্তুনিষ্ঠ দৃষ্টিকোণ থেকে ইতিহাসকে বিচার করেছেন। এই গ্রন্থের বিষয়বস্তু সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ বলেন যে,
"মোঘল রাজত্বের পূর্বে তিনশত বছরব্যাপী কালরাত্রে ভারত সিংহাসনে দাস বংশ থেকে লোদী বংশ পর্যন্ত পাঠান রাজণ্যবর্গের যে রক্তবর্ণ উল্কা বৃষ্টি হয়েছে গ্রন্থে তার একটা বিবরণ থাকলে ভাল হতো।"
এখানে লক্ষ্যণীয় বিষয়টি হলো ভারতবর্ষের ইতিহাসে সুলতানী শাসনামলকে রবীন্দ্রনাথ ভারত ইতিহাসের কাল অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত করতে প্রয়াসী হয়েছেন। ভারতীয় ইতিহাসের সুলতানী যুগের সুদীর্ঘ তিন শতাব্দী সময়কালকে কালো অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত করার রবীন্দ্রনাথের এই প্রয়াস অনৈতিহাসিক, সাম্প্রদায়িক এবং মুসলিম বিদ্বেষপ্রসূত। সুলতানী আমলে ভারতের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে বহুল উন্নতি সাধিত হয়। এই সময়কালে ভারতে একটি প্রাতিষ্ঠানিক শাসন কাঠামো গড়ে উঠে। শিক্ষা ও শিল্পকলায় নতুন দিগন্তের সূচনা ঘটে। বহির্বিশ্বের সাথে ভারতের প্রত্যক্ষ বাণিজ্যিক ও সাংস্কৃতিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়। ভারতের নিম্নবর্গের মানুষ ব্রাহ্মণদের সামাজিক অত্যাচার থেকে রেহাই পায়। বাংলার ইতিহাসে সুলতানী আমল একটি স্বর্ণোজ্জল অধ্যায়। মুসলিম সুলতানদের হাতেই বাংলা ভাষার পূর্ণ সমৃদ্ধি ঘটে। মুসলিম শাসকেরা বাংলা ভাষাকে নিজের ভাষা হিসেবে গ্রহণ করে এবং এই ভাষার ব্যাপক পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান করে। এই সময়কালটি বাংলা ভাষা বিকাশের সোনালী যুগ। আরবী ও ফারসী ভাষার সংস্পর্শে এসে সমৃদ্ধ হয় বাংলা ভাষা। বাংলা সাহিত্যে নোবেলজয়ী রবীন্দ্রনাথ এই সুলতানী আমলকে বলেছেন ইতিহাসের কালো অধ্যায়। এখানে তিনি মুসলিম বিদ্বেষ থেকে ইতিহাস বিকৃতিতে অবতীর্ণ।
... ঐতিহাসিক প্রামাণ্য তথ্যে এটা স্বীকৃত যে পলাশী পূর্ববর্তী সুবে বাংলার অর্থাৎ বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার জনজীবন সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত হযে পড়েছিল মারাঠা দস্যু আর সন্ত্রাসীদের হামলা, লুন্ঠন, হত্যা ও আক্রমণে। নবাব আলীবর্দী খান মারাঠা সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ যুদ্ধে তার শাসনামলের প্রায় পুরো সময়কালটি ব্যাপৃত থাকেন। উনিশ শতকের হিন্দু উচ্চ ও মধ্যবিত্ত শ্রেণী এই ঐতিহাসিক সত্য ভুলে সন্ত্রাসী মারাঠাদের আক্রমণ, লুটপাট আর কর্মকান্ডকে মুসলিম বিরোধী অভিহিত করে হিন্দুদের গৌরব চিহ্নিত করতে থাকে। প্রধানত: এই হিন্দু পুনরুত্থানবাদী আন্দোলনের পটভূমিতে বাংলার হিন্দুসমাজ বিজাতীয় মারাঠাদের গুণকীর্তন আর বন্দনা শুরু করে। রবীন্দ্রনাথ ছিলেন এই ধারারই শক্তিশালী প্রবক্তা।
... 'শিবাজী উৎসব্' (১৯০৪) কবিতাটি যখন রবীন্দ্রনাথ রচনা করেন তখন তিনি কবি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। একই সঙ্গে কলকাতার বুদ্ধিজীবী মহলেও তিনি সম্মানের সাথে সমাদৃত। পারিবারিক এবং আর্থিক কারণে তিনি কলকাতার অভিজাত মহলের নেতৃস্থানীয় পর্যায়ে অবস্থান করছেন। বয়েসের পরিসীমায়ও তিনি পরিণত। বলা যেতে পারে উনিশ শতকের শেষ এবং বিশ শতকের শুরুর পর্বের রবীন্দ্রনাথের চিন্তা ও কর্মের ধারাবাহিকতার সাথে কবিতাটির মর্মার্থ ওতপ্রোতভাবে জড়িত। মহারাষ্ট্রের বালগঙ্গাধর তিলক ১৮৯৫ সালের ১৫ এপ্রিল সেখানে শিবাজী উৎসব প্রতিষ্ঠা করেন। তিলক শিবাজী উৎসব প্রতিষ্ঠা করেছিলেন উগ্র হিন্দু জাতীয়তা ও সাম্প্রদায়িকতা প্রচার ও প্রসারের জন্য। ক্রমে শিবাজী উৎসবের অনুকরণে চালু হয় গণপতি পূজা। ইতিপূর্বে ১৮৯৩ সালে প্রতিষ্ঠিত গো-রক্ষিণী সভা ঐ অঞ্চলে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করে। মহারাষ্টের শিবাজী উৎসবের অনুকরণে সখারাম গণেশ দেউস্করের প্রচেষ্টায় কলকাতায় শিবাজী উৎসব প্রচলিত হয় ১৯০২ সালের ২১ জুন তারিখে। সরলা দেবী ১৯০২ সালের অক্টোবর মাসে দূর্গাপূজার মহাষ্টমীর দিনে বীরাষ্টমী উৎসব প্রচলন করেন। তিনি ১৯০৩ সালের ১০ মে শিবাজী উৎসবের অনুকরণে প্রতাপাদিত্য উৎসব প্রচলন করেন এবং একই বছরের ২০ সেপ্টেম্বর তারিখে প্রবর্তন করেন উদয়াদিত্য উৎসব। কলকাতার বাইরে থাকার কারণে রবীন্দ্রনাথ এই তিনটি উৎসবে উপস্থিত ছিলেন না। কিন্তু ২৯ সেপ্টেম্বর ১৯০৩ সালে দূর্গাপূজার মহাষ্টমীর দিনে ২৬ বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডে জানকীনাথ ঘোষালের বাড়িতে যে বীরাষ্টমী উৎসব অনুষ্ঠিত হয় রবীন্দ্রনাথ তাতে সক্রিয়ভাবে যোগ দেন।
... শিবাজী উৎসবের মূল মন্ত্র ছিল চরম মুসলিম বিদ্বেষ, সন্ত্রাস এবং সাম্প্রদায়িকতা। বস্তুত এই শিবাজী উৎসবের সূত্র ধরেই বাংলায় সন্ত্রাসবাদী রাজনীতির এবং সাম্প্রদায়িক ভেদনীতির ভিত্তি স্থাপিত হয়। এর ফলশ্রুতিতে বাঙালি হিন্দু ও বাঙালি মুসলমান পরস্পর বিপরীত পথে ধাবিত হয়। ঐতিহাসিকভাবে এটা স্বীকার্য যে এই সন্ত্রাস আর সাম্প্রদায়িক রাজনীতির দায়ভাগ পুরোপুরি বর্তায় হিন্দু জমিদার আর মধ্যবিত্ত শ্রেণীর উপর্। 'শিবাজী উৎসব' পালনের মধ্য দিয়ে সমগ্র বাংলায় যখন মুসলিম বিদ্বেষ আর সাম্প্রদায়িক রাজনীতি এবং সমাজনীতির ভূমি নির্মিত হচ্ছে তখন বাঙালি মুসলিম সমাজ অর্থে, বিত্তে, শিক্ষায় একটি পিছিয়ে পড়া সম্প্রদায়। আর পূর্ববাংলায় বাঙালি মুসলিম জসংখ্যার সিংহভাগ জমিদারদের রায়ত বা প্রজা। বাংলার হিন্দুরা মুসলমানদের প্রতিপক্ষ হিসেবে বিবেচনা করলেও হিন্দু জমিদার আর মধ্যবিত্তের প্রতিপক্ষ হয়ে উঠার শক্তি বা অবস্থা বাঙালি মুসলমানের ছিল না। কিন্তু বাস্তব ইতিহাস হলো বিশ শতকের শুরুতে এই সাম্প্রদায়িক 'শিবাজী উৎসব' বাংলায় চালু হয়েছিল মুসলিম বিরোধীতা এবং মুসলিম বিদ্বেষকে পুঁজি করে।
কবিতার শুরুতে রবীন্দ্রনাথ শিবাজীর কর্মকান্ড ও জীবনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলেন :
কোন দূর শতাব্দের এক অখ্যাত দিবসে
নাহি জানি আজ
মারাঠার কোন শৈল অরণ্যের অন্ধকারে ব'সে
হে রাজা শিবাজী
তব ভাল উদ্ভাসয়া এ ভাবনা তরিৎ প্রভাবৎ
এসেছিল নামি
'একরাজ্যধর্ম পাশে খন্ড ছিন্ন বিক্ষিপ্ত ভারত
বেধে দিব আমি'।
এখানে রবীন্দ্রনাথ শিবাজীকে ভারতের ঐক্যের প্রতীক হিসেবে তুলে ধরেছেন। তিনি বলতে চেয়েছেন যে খন্ড, ছিন্ন, বিক্ষিপ্ত ভারত ধর্মের ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ করা ছিল শিবাজীর জীবনের উদ্দেশ্য। মহারাষ্ট্রে শিবাজী উৎসবের প্রচলন, পরবর্তী সময়ে কলকাতাসহ ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে শিবাজী উৎসব প্রচলনের এবং এই উৎসবকে জনপ্রিয় করে তোলার জন্য নিবেদিত প্রাণ বালগঙ্গাধর তিলক এবং সখারাম দেউস্করের মূল উদ্দেশ্য ছিল শিবাজীর আদর্শে ভারতকে ঐক্যবদ্ধ করা। এখানে এটা স্পষ্টত:ই লক্ষ্যণীয় যে তিলক, দেউস্কর আর রবীন্দ্রনাথের ভাবনা সম্পূর্ণ অভিন্ন।
... মুসলিম শাসকেরা কখনোই ইসলাম ধর্মকে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর উপর চাপিয়ে দেয়নি কিংবা ইসলাম গ্রহণের জন্য কোন প্রকার জোর জবরদস্তি করেনি। জাত-পাত আর বহুবর্ণে বিভক্ত এবং কুসংস্কারে আচ্ছন্ন ভারতীয় জনগোষ্ঠীর একটি অংশ স্বেচ্ছায় ইসলামের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে ইসলাম গ্রহণ করেছে। ইতিহাসে এটাও স্বীকার্য যে সমগ্র ভারতবর্ষকে মুসলিম শক্তিই প্রথম এককেন্দ্রীক শাসনের আওতায় নিয়ে এসেছে। আর ভারতের ঐক্য স্থাপন কখনোই ধর্মের ভিত্তিতে হয়নি। মুসলিম রাজনৈতিক পতাকাতলে ভারতবর্ষ ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল। সতেরো শতকের ভারত ইতিহাসে শিবাজী একজন মুসলিল বিরোধী, সন্ত্রাসী, লুন্ঠনকারী ও বিশ্বাসভঙ্গকারী আঞ্চলিক দলনেতা। শিবাজীর আদর্শ হলো একমাত্র মুসলিম শাসনের বিরোধিতা। এখানে রবীন্দ্রনাথ শিবাজীর হিন্দুধর্ম আর সন্ত্রাসের আদর্শে ভারতকে এক করতে অনুপ্রাণিত হয়েছেন। শিবাজীর আদর্শে রবীন্দ্রনাথের অনুপ্রাণিত হওয়ার বিষয়টি পুরোপুরি সাম্প্রদায়িক, মুসলিম বিদ্বেষী এবং আবহমানকাল ধরে চলে আসা বাংলা ও ভারতের সমাজ ও সংস্কৃতি ধারার বিরোধী।
... ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে নবাব সিরাজদৌল্লার পরাজয়ের পটভূমিতে একদিকে বাংলার স্বাধীনতা সূর্য অস্তমিত হয় এবং অন্যদিকে বাংলায় সুদীর্ঘ মুসলিম শাসনের অবসান ঘটে। যেহেতু রাজশক্তি মুসলমানদের কাছ থেকে ইংরেজরা ক্ষমতা দখল করে ঔপনিবেশিক শাসন প্রতিষ্ঠা করেছিল তাই তাদের প্রধান শত্রু হয়ে দাঁড়ায় বাংলার মুসলমান সমাজ। ইংরেজ শক্তি বাংলার মুসলমান সমাজের উপর শুরু করে শোষণ, নিপীড়ন আর নির্যাতন। অন্যদিকে বাংলার হিন্দু সমাজ শুরু করে বৃটিশ শক্তির পদলেহন ও দালালী। তারা ইংরেজ কোম্পানির দালালী, মুৎসুদ্দী আর বেনিয়াগিরী করে প্রভুত অর্থের মালিক হওয়ার পাশাপাশি ইংরেজি শিক্ষাকে গ্রহণ করে। অন্যদিকে মুসলমান সমাজ তাদের ঐতিহ্য, ধর্ম ও সংস্কৃতি নষ্ট হওয়ার ভয়ে ইংরেজি শিক্ষা থেকে দূরে থাকে। ক্রমে রাজক্ষমতা, প্রশাসনিক কর্তৃৃত্ব মুসলমানদের হাতছাড়া হয়ে যায়। উপরন্তু রাজভাষা ফারসীর পরিবর্তে ইংরেজি চালু হলে মুসলমান সমাজ যুগপৎ ভূমি ও সরকারী চাকুরীর সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়ে একটি দরিদ্র শ্রেণীতে পরিণত হয়। ইংরেজি শিক্ষা গ্রহণের আর্থিক সামর্থ্য মুসলমানদের ছিল না। এই পটভূমিতে ইংরেজদের পদলেহী হিন্দু সমাজের একাংশ দালালী আর বেনিয়াগিরী করে প্রচুর অর্থ উপার্জন করে। ১৭৯৩ সালের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তনের পটভূমিতে এই সকল দালাল-বেনিয়ারা অর্থ দিয়ে সরকারের কাছ থেকে জমি বন্দোবস্ত নিয়ে জমিদার শ্রেণীতে পরিণত হয়।
এই ইংরেজদের দালালদেরই একজন রবীন্দ্রনাথের প্রপিতামহ দ্বারকানাথ ঠাকুর। এই দালাল শ্রেণীর কাছে ইংরেজ শাসন ছিল আশীর্বাদ স্বরূপ। অন্যদিকে বাংলার মুসলমান সমাজ ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে পরিচালনা করে একটানা আন্দোলন সংগ্রাম। আঠারো ও উনিশ শতকের বাংলার কৃষক বিদ্রোহ ও গণতান্ত্রিক সংগ্রামের পুরোভাগে ছিল বাংলার মুসলমান সমাজ। বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদী শাসনকে বাংলার মুসলমান সমাজ কখনোই মেনে নিতে পারেনি। অন্যদিকে বাংলার হিন্দু সমাজের বেলায় পরিস্থিত ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। হিন্দু জমিদার, মহাজন, বেনিয়া আর মধ্যবিত্ত শ্রেণী ছিল বৃৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের সহযোগী শক্তি। ঐতিহাসিকভাবে এটা বলা যায় বাংলার তথা ভারতীয় মুসলমান সমাজকে যুগপৎ বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদ এবং তাদের সহযোগী হিন্দু শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করতে হয়েছে। আর এই ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে নির্মিত হয়েছে হিন্দু-মুসলিম স্থায়ী বিভাজন রেখা।
... মুঘল তথা মুসলিম শক্তির বিরুদ্ধে গুপ্ত হামলা পরিচালনা, হত্যা, খুন এবং গোপন আস্তানায় থেকে মুসলমানদের বিরুদ্ধে লুন্ঠন পরিচালনার জন্য রবীন্দ্রনাথের ভাষায় শিবাজী ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন। তিনি আরও বলেন যে শিবাজীর ইতিহাস চাপা দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু শিবাজীর তপস্যা সত্য ছিল বলে তাকে ইতিহাসে চাপা দেয়া যায়নি। মুসলিম ও ইংরেজ ঐতিহাসিকদের বস্তুনিষ্ঠ গবেষণায় এটা প্রমাণিত হয়েছে যে শিবাজী একজন লুন্ঠনকারী, হত্যাকারী, আত্মগোপনকারী, সন্ত্রাসী মারাঠা দলনেতা। তার কার্যক্রম সীমিত ছিল বিশাল মুঘল সাম্রাজ্যের এক ক্ষুদ্র অঞ্চলে। সতেরো শতকের ভারতীয় ইতিহাসে একটি প্রমাণিত ও সত্যনিষ্ঠ ঐতিহাসিক সিদ্ধান্তের বিপরীতে রবীন্দ্রনাথের এই অবস্থান প্রমাণ করে তিনি মুসলিম বিরোধী হিন্দু পুনরুত্থানবাদী ও আর্য সংস্কৃৃতির ডামাডোলে কতটা নিমজ্জিত ছিলেন। সামাজিক ও শ্রেণীগত অবস্থানে রবীন্দ্রনাথ ইংরেজ শাসনের মহিমায় মুখর। তিনিই পরবর্তীকালে সম্রাট পঞ্চম জর্জের দিল্লি আগমন উপলক্ষ্যে রচনা করেন 'জনগণমন অধিনায়ক জয় হে ভারত ভাগ্যবিধাতা' সঙ্গীত। এটা এখন ভারতের জাতীয় সঙ্গীত। রবীন্দ্রনাথের এই ভাগ্যবিধাতা আল্লাহ বা ঈশ্বর নয়, খোদ বৃৃটিশ সাম্রাজ্যবাদ।
... রবীন্দ্রনাথ বলতে চেয়েছেন যে, মুঘলবিরোধী, লুন্ঠনকারী আর সন্ত্রাসী শিবাজী কর্মকান্ড ভারতের ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছে। আর এই ঐতিহ্য হলো মুসলিম বিরোধীতা, মুসলমানদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাস পরিচালনা এবং মুসলমানদেরকে ভারতবর্ষ থেকে বিতাড়িত করার সঙ্কল্প। বাঙালি হিন্দুদের মাঝে বিশেষত: ১৭৫৭ সালের পলাশী যুদ্ধোত্তরকালে নব উত্থিত হিন্দু বেনিয়া, দালাল, মহাজন, জমিদার শ্রেণী বাংলা ও ভারতের মুসলিম শাসনের বিরুদ্ধে বিষোদগার করতে থাকে। উনিশ শতকের বিকশিত হিন্দু মধ্যবিত্ত শ্রেণীর বড় অংশই ছিল মুসলিম বিদ্বেষী এবং বাংলার মুসলমান সমাজ সম্পর্কে উন্নাসিক মনোভাবাপন্ন। বিশ শতকের হিন্দু জমিদার আর মধ্যবিত্তের প্রধান অংশই হলো এই ধারার বাহক। হিন্দু-মুসলিম বিরোধ সৃষ্টি, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট, দুই সম্প্রদায়ের মাঝে দাঙ্গা হানাহানি এবং পরিশেষে ধর্মের ভিত্তিতে ভারত বিভাগের দায়িত্ব ঐতিহাসিকভাবে বর্তায় এই হিন্দু উচ্চবিত্ত আর মধ্যবিত্তের উপর।
... বঙ্গভঙ্গের পটভূমিতে বাঙালি শিবাজীকে নেতা হিসেবে বরণ করে নেয়। শিবাজীর মহৎ নাম বাঙালি আর মারাঠা জাতিকে এক সূত্রে গেঁথে দেয়। রবীন্দ্রনাথের এই এক সূত্রে গাঁথার মূল সূত্রটি হলো মুসলিম বিরোধীতা। শিবাজী মুসলিম বিদ্বেষী তাই আসন্ন বঙ্গভঙ্গের পটভূমিতে মুসলমানদের উপর সামাজিক প্রভাব বহাল রাখা এবং সামাজিক শোষণ করার পথ বন্ধ হওয়ার প্রেক্ষাপটে বাঙালি হিন্দু জমিদার আর মধ্যবিত্ত সমাজ মুসলিম বিরোধীতায় অবতীর্ণ। এখানেই মুসলিম বিরোধীতার হাতিয়ার হিসেবে মুসলিম বিদ্বেষী মারাঠী সন্ত্রাসী শিবাজীকে বাঙালি হিন্দু সমাজ বরণ করে নিয়েছে, আপন করে নিয়েছে। মুসলিম বিরোধী বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনে শিবাজী বাঙালি হিন্দুদের কাছে আদর্শ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। শিবাজীর পথ ধরেই এগিয়ে যাওয়ার পথের সন্ধান পেয়েছিল বাঙালি হিন্দু সমাজ। শিবাজী মুঘল শক্তির বিরুদ্ধে আর বাঙালি হিন্দু সমাজ প্রতিবেশী মুসলিম সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে। এখানেই শিবাজীর সাথে বাঙালি হিন্দুদের আদর্শিক ও স্বার্থগত সম্পর্কের মিল॥"
https://www.facebook.com/kay.kavus/posts/394946010687289?fref=nf